Responsive Ads Here

18 January 2012

ভুতুরে গল্প-৩

রাত ১১ টা। হাসপাতালের আই সি ইউ রুমের বাইরে অস্থিরচিত্তে পায়চারী করছেন সুলতান সাহেব। সেলিমের জ্ঞান ফিরে নি এখনো। বিকেলবেলা উনি আর মিলির মা বসে টুকটাক গল্প করছিলেন এর মাঝে ভয়ঙ্কর চিৎকার শুনে ঘাবড়ে যান দুজনই। তাড়াহুড়া করে বাইরে এসে দেখেন লনে অচেতন হয়ে সেলিম পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি কোনোমতে টেনে হেঁচড়ে রুমে ঢুকানো হয় তাকে। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ায় কোনও লাভ না হওয়ায় নিয়ে আসতে হয় সদর হাসপাতালে। লন থেকে সেলিমের দেহ ধরাধরি করে রুমে ঢুকানোর সময় সুলতান সাহেব অবাক হয়ে যান। দেহটি একদম পানির মতো ঠাণ্ডা। একটানা ৩০-৪০ মিনিট কেউ পানিতে থাকলে যেমন হয়, ঠিক তেমনি। ঘাড়ের কাছে একটা কালো পুড়া দাগ লক্ষ্য করেন তিনি। আগে কখনো সেলিমের ঘাড়ে এই দাগ দেখেছেন বলে মনে পড়ছে না। নতুন বাড়িটায় আসলে আসা উচিত হয় নি। একের পর এক অঘটন ঘটেই চলছে। এদিকে অফিসের অবস্থাও ভালো না। তার চেয়ে জুনিয়র বয়সী এক ছেলে ঝামেলা করা শুরু করেছে। এই শাখার হেড হবার কথা ছিল তার, কিন্তু অফিস থেকে সুলতান সাহেবকে মনোনীত করায় তার ক্ষোভ বেড়েছে। সাঙ্গপাঙ্গ গুছিয়ে একটা ঝামেলা পাকানোর তালে এখন সে।

ভাবনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে আই সি ইউ রুম থেকে বের হয়ে এলেন ডিউটি ডক্টর। বয়স খুবই কম। নিজেকে পরিচয় দিয়েছে সেলিম সাহেবের ছাত্র বলে। সম্ভবত নতুন জয়েন করেছে। সুলতান সাহেব এগিয়ে গিয়ে রুগীর অবস্থা জানতে চাইলেন।

“অবস্থা স্বাভাবিক। মাঝে একবার জ্ঞান ফিরেছিল কিছুক্ষণের জন্য। কোনও কথা বলেন নি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। সব ঠিকঠাক থাকলে কাল নাগাদ বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন স্যারকে।”

সুলতান সাহেবের চিন্তা কিছুটা কমলো। সেলিমের বউয়ের কোনও বাচ্চাকাচ্চা নেই। বেচারি ঘটনার পর থেকে একটানা কাঁদছে। হাসপাতালে চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ কেঁদেছে। সুলতান সাহেব কয়েকবার বুঝানোর চেষ্টা করে বাদ দিয়েছেন। এরপর মিলির মার কাছে উনাকে রেখে তিনি একা চলে এসেছেন হাসপাতালে আবার খবর নিতে।

ডিউটি ডক্টরের গ্রাউনে লেখা নাম পড়লেন তিনি। ইমরান চৌধুরী। গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তা বাবা ইমরান, এখানে কি আমার থাকতে হবে? বয়স হয়ে গেছে তো বাবা, রাত জাগতে কষ্ট হয়। তাই তেমন সিরিয়াস কিছু না হলে বাসায় চলে যাই। আর আমার মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে যাই। যখনই লাগে তুমি ফোন দিলেই আমি চলে আসবো।”

“অবশ্যই স্যার। আপনি চলে যান। সেলিম স্যারের সাথে আমি আছি। আজকে সারারাত ডিউটি আমার। আমি কিছুক্ষণ পরপর স্যারের খোঁজ নিবো। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।”

সুলতান সাহেব ডক্টরকে ধন্যবাদ দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এলেন। চামড়ার চোখে দেখতে পেলেন না যে উনি বের হবার সাথে সাথে একটা কালো ছায়া সেই হাসপাতালের করিডরে ঢুকল। খুব দ্রুত অগ্রসর হতে লাগলো আই সি ইউ রুমের দিকে। যেখানে সেলিমকে রাখা হয়েছে।

***************************************************

ঠিক রাত ২টার দিকে আচমকা প্রচণ্ড ব্যাথায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো সেলিম সাহেবের। ঘাড়ের পাশের পুড়া জায়গাটা ধপধপ করছে। শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে। হাসপাতালে আই সি ইউ কক্ষে তাকে রাখা হয়েছে এটা তিনি বুঝতে পারলেন। পাশের বেডে একজন রুগীকে দেখা যাচ্ছে। গভীর ঘুমে অচেতন।

হটাত ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় নাকে এসে ধাক্কা দিলো কড়া ডেটলের গন্ধ। একবার ভাবলেন মাথাটা উঠিয়ে দেখবেন আশে পাশে কেউ আছে কিনা। পেইনকিলার দিলে কাজ হতো। মাথাটা উঁচিয়ে সোজা সামনে তাকাতেই এক সাথে কয়েকটা বিট মিস করলেন তিনি।

পায়ের কাছে বসে আছে সেই মেয়েটি! যাকে আজ দুপুরে ছাদ থেকে পড়ে যেতে দেখেছেন। ঘন কালো চুলের ওপাশ থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে সেলিম সাহেবের প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করছে সে। সেলিম সাহেব মেয়েটিকে দেখে বরফের মত জমে গেলেন। কেন যেনও তার ৬ষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বার বার সতর্ক করতে লাগলো অনাহূত বিপদ সম্পর্কে। সেলিম সাহেব নার্ভ ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলেন।

গলা দিয়ে কোনও কথা বের হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “কে তুমি? আর কি চাও আমার কাছে? কেন এমন করে আমার পিছনে লেগেছ?”

মেয়েটি যেনও কিছু শুনতে পায় নি এমন করে বসে রইলো। তারপর সেলিম সাহেবকে চমকে দিয়ে হেঁচড়ে হেঁচড়ে উনার উপরে চড়ে বসলো।

সেলিম সাহেব আপ্রান চেষ্টা করতে লাগলেন চিৎকার করার। উনার বারবার মনে হচ্ছে তিনি যা দেখছেন তা শুধুই স্বপ্ন। বাস্তবে এটা ঘটা সম্ভব না। হাসপাতালের সব সিকিউরিটির চোখ ফাঁকি দিয়ে একটা মেয়ে কখনোই আই সি ইউ রুম পর্যন্ত আসতে পারবে না। তিনি চোখ বন্ধ করে একটানা সূরা পড়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনও সূরা মনে পড়লো না তার।

বুকের উপর ভারি কিছু চেপে বসার সাথে সাথেই আবারো চোখ খুলতে বাধ্য হলেন তিনি। মেয়েটি তার বুক পর্যন্ত চলে এসেছে। এতো কাছ থেকে দেখে মেয়েটির অনেক কয়টি ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে পারলেন তিনি। মেয়েটির বয়স ১০-১২ বছরের বেশি হবে না। গায়ের চামড়া ফ্যাঁকাসে বর্ণের। দীর্ঘদিন কেউ সূর্যের আলোতে বাইরে বের না হলে চামড়ার রঙ যেমন হয়ে যায়, ঠিক সেই রঙ। আরেকটা জিনিসের সাথে মিলে যায়। মরা মানুষের চামড়ার রঙ হয় এমন! চুলগুলোর সাথে মিলির রুমে পাওয়া চুলগুলো একদম হুবুহু মিলে যায়। চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না পরিষ্কার। তবে সব মিলিয়ে উনার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে এই সেই মেয়েটি! যাকে সবাই দেখত বলে দাবি করতো। যাকে দেখা যেতো ঐ বাড়ির আশে পাশে।

মেয়েটি যেনও সেলিম সাহেবের মনের ইচ্ছে বুঝতে পারলো। একটা হাত মুখের সামনে এনে মুখের কাছের চুলগুলো সরিয়ে দিলো। মুখটি দেখে একই সাথে ভয় এবং প্রবল ঘৃণা গ্রাস করলো সেলিম সাহেবকে। মেয়েটির সারা মুখ জুড়ে পুড়া দাগ। কিছু কিছু জায়গা বেশি পুড়েছে, কিছু জায়গা কম পুড়েছে। কম পুড়া জায়গাগুলো রক্ত জমে লালচে হয়ে আছে। সেখান থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পোঁচ পড়ছে। সেলিম সাহেবের সাদা ড্রেসটি আস্তে আস্তে সেই পোঁচ দিয়ে ভিজে যেতে লাগলো। সাথে সাথে কেমন যেনও একটা পচা বাসি গন্ধ এসে ধাক্কা মারল সেলিম সাহেবের নাকে।

মেয়েটিকে দেখে মনে হল সেলিম সাহবের ভয় পাওয়া সে খুব উপভগ করছে। এবার বুকের উপর বসেই আস্তে করে নিজের মুখটা সেলিম সাহবের দিকে বাড়িয়ে দিলো। যেনও সেলিম সাহেবকে দেখাতে চায় তার মুখ কতটা বীভৎস! সেলিম সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না। চোখ বন্ধ করে ফেললেন।

সাথে সাথে মেয়েটি নিজের এক হাত দিয়ে সেলিম সাহবের গলা চেপে ধরল। প্রবল আক্রোশে সেলিম সাহেবের গলায় সাঁড়াশির মতো চেপে বসতে লাগলো সেই হাত। সেলিম সাহেব নিজের প্রাণপণ শক্তি দিয়ে দুহাতে সেই হাতটি সরানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। শক্তি হারাচ্ছেন তিনি আস্তে আস্তে। এখুনি কিছু না করতে পারলে বাঁচার আশা নেই। এলোপাথাড়ি হাত চালাতে লাগলেন তিনি মেয়েটার শরীর লক্ষ্য করে।


মেয়েটি যেনও এই অসম লড়াই খুব উপভোগ করছে। হা করে হাসার চেষ্টা করলো। ঠিক সেই সময়ে মুখ থেকে খসে পড়লো তার ছোটবেলায় কেটে ফেলা জিহ্বাটা। দৃশটা সহ্য হল না সেলিম সাহেবের। শেষ চেষ্টা স্বরূপ মুখ দিয়ে একটা চিৎকার বের করার চেষ্টা করলেন। চিৎকারটা গলা পর্যন্ত এসে আটকে গেলো। মুখ দিয়ে বের করার জন্য আর বেঁচে রইলেন না।

সেই রাতে ভোর ৪টার দিকে সুলতান সাহেবের মোবাইল হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানানো হয় সেলিম সাহেব মারা গেছেন। মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ডাক্তাররা নিশ্চিত নয়!

(চলবে)

No comments:

Post a Comment