Responsive Ads Here

18 January 2012

ভুতুরে গল্প-৪

বাবা খুব ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছেন। কি নাকি জরুরী কাজ আছে। ঘুম থেকে উঠেই মিলি দেখল মার চোখটা ভেজা ভেজা। কারণ জিজ্ঞেস করলে মমতাজ বেগম কোনও উত্তর দেন নি। ধুঁকরে কেঁদে উঠেন বারবার। মিলি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুই বুঝতে পারে না। কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর তিনি বললেন এমনিতেই মন খারাপ। মিলি বেশী জোরাজুরি করেনি। মার বলার হলে একবার জিজ্ঞেস করলেই বলতো। যেহেতু বলতে চাচ্ছে না তারমানে হাজারবার জিজ্ঞেস করলেও উনি বলবেন না।

মিলিকে তার ছোট মামার মৃত্যুর সংবাদ জানানো হয় নি। সুলতান সাহেব এমনি নির্দেশ দিয়ে গেছেন। ভোরে ফোন পেয়েই তিনি গাড়ি নিয়ে বের হন। হাসপাতালে পৌছার পর জানান একবারে দাফন কাজ সম্পন্ন করে বাসায় ফিরবেন। সুলতান সাহেবের শ্বশুর বাড়ি অর্থাৎ সেলিমের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে। ভোরে হাসপাতালের গাড়ি নিয়ে বের হলে দাফন কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হবে। বাসায় থাকাকালীন সময়ে এক মুহূর্তের জন্যও যেনও মিলি চোখের আড়ালে যেতে না পারে এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সেলিমের কথা শুনে হয়তো মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে যাবে তাই বলেছেন উনি এসে বলবেন না বলার।

এ্যাম্বুলেন্সের পিছনে বসে সেলিমের মৃতদেহের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সুলতান সাহেব। গতকালও তার সাথে এই সময়ে মিলির ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছিল আর আজকে সে একটা লাশ! যার কথা বলার ক্ষমতা নেই, নেই নড়াচড়ার ক্ষমতা। হাসপাতালে যাবার পর ডাক্তারের সাথে ১০ মিনিটের মতো কথা হয় উনার। তাদের ভাষ্যমতে, রাত আনুমানিক ২টার দিকে ডিউটি ডাক্তার ইমরান শেষবার সেলিম সাহেবকে দেখতে যায়। তখন তিনি নরমাল ছিলেন এবং যাবতীয় সব কার্যকলাপ স্বাভাবিক ছিল। এরপর আবার যখন তাকে দেখার জন্য ডাক্তার ইমরান যান তখন তাকে মৃত দেখতে পান। লক্ষণীয় ব্যাপার হল উনার গায়ের সাদা চাদরটার উপর এক প্রকার থকথকে জেলির মতো পদার্থ লেগে ছিল। হলুদ বর্ণের। তা কোথা থেকে এসেছে সে ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারছে না। মমতাজ বেগম ভাইকে শেষবারের মতো দেখতে হাসপাতালে এসেছিলেন। কেঁদে কেটে অস্থির অবস্থা। সুলতান সাহেব এক প্রকার জোর করে পাঠিয়ে দেন উনাকে। মিলি বাসায় একা, তার উপর চোখ রাখা দরকার।

দাফন পর্ব শেষ করে সন্ধ্যা ৬ টার দিকে ফিরতি পথ ধরলেন সুলতান সাহেব। মনটা বিষণ্ণ। লাশ পৌঁছানর পর পুরো বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায়। পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলে ছিলেন সেলিম সাহেব। সুলতান সাহেবের বৃদ্ধ শাশুড়ি বারবার বিলাপ করে বলছিলেন কেন আল্লাহ তার ছেলের জায়গায় তাকে নিয়ে গেলো না। কথাগুলো সহ্য হচ্ছিল না সুলতান সাহেবের। তাই বাড়ির সবাই জোর করলেও তিনি না থেকে রাতের বেলা বাড়ি ফিরবেন বলে চলে এসেছেন।

***********************************************

মা সারাদিনই কিছুক্ষণ পর পর থেকে থেকে কেঁদেছেন। শেষে মাকে না জানিয়ে মিলি উনাকে জোর করে একটা ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে। বলেছে ভিটামিনের ট্যাবলেট। নিজের কাছেই খারাপ লাগছিল তবে এছাড়া আর উপায় ছিল না। মার কান্না সহ্য হয় না তার। এছাড়া মা কারণটাও জানাচ্ছে না। বাবা ফিরলে হয়তো জানা যাবে। উনাদের মধ্যে হয়তো কোনও ঝামেলা হয়েছে তাই মা চাচ্ছে না মিলিকে জানাতে।

মাকে রুমে সুন্দর করে চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়ে মিলি পড়ার রুমে চলে গেলো। উদ্দেশ্য কম্পিউটারে কিছুক্ষণ গান শোনা। বিকেলে অবসর সময়টা তার কাটে গান শুনে না হয় গল্পের বই পড়ে। আগে যখন পুরনো বাসায় ছিল তখন মাঝে মাঝে বান্ধবীদের সাথে তাদের বাসায় যেতো না হয় ছাদে গিয়ে সময় কাটাত। এখানে আসার পর থেকে তেমন কোনও কাজ নেই।

গুনগুন করতে করতে কম্পিউটারটা অন করলো মিলি। নিজের পছন্দের প্লে লিস্টটা চালিয়ে দিয়ে ইন্টারনেট ওপেন করলো। গতকাল রাতেই অফিসের কেরানী এসে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে গেছে। এখানে আসার পর থেকে পেপার পড়া হয় নি। নেটে তার প্রিয় পত্রিকার ওয়েবসাইটটি ওপেন করলো সে।

প্রথম পাতা থেকে বিনোদনের পাতা পর্যন্ত সব পাতাতেই হাল্কা করে নজর বুলাতে লাগলো সে। স্পীকারে মৃদু শব্দে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজচ্ছে। হটাত করে পিছনে ধপাস করে কিছু পড়ার শব্দ হল। মিলি মাথা বাকিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখল দেয়ালে আটকানো শেলফ থেকে তার এবং তার বাবার একত্রে তোলা ছবির স্ট্যান্ডটা নিচে পড়ে গেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে ছবিটা আবার জায়গা মতো রেখে এল সে।

মিনিটখানেক বাদে আবার একই আওয়াজ। আবারো ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাল মিলি। দেখল সেই একই কাণ্ড। ছবির স্ট্যান্ডটা মাটিতে পড়ে আছে। বিরক্ত হয়ে আবারো উঠলো সে। বই দিয়ে ভালো করে চাপা দিয়ে রেখে এলো স্ট্যান্ডটা। মনোযোগের বিঘ্ন ঘটায় মেজাজ কিছুটা খারাপ হল।

চেয়ারে বসে আবারো পত্রিকার পাতায় ডুব দিলো সে। মিনিটখানেক কেটে গেলো। এবার আর কিছু ঘটলো না। মিলি গভীর মনোযোগে একটা সায়েন্সের উপর লেখা আর্টিকেল পড়ছিল। হটাত কম্পিউটারে কার যেনও ছায়া পড়লো। মিলি প্রথমে ধরতে পারলো না। মাথা ঘুড়িয়ে একবার পিছনে দেখে নিলো। কিছু নেই। রুমটা পুরো ফাঁকা। আবারো ঘুরে পড়তে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর আবার একই দৃশ্য। মিলি এবার পিছনে না ঘুরে গাঁট মেরে বসে রইলো। ভালো করে বুঝলে চাইলো সে ঘটনাটা।

বেশীক্ষণ লাগলো না। ১০ সেকেন্ড পরেই মনিটরের স্ক্রিনে একটা পরিষ্কার অভয়ব দেখে চমকে উঠলো মিলি। সেই মেয়েটার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে পর্দায়। যাকে সে সেদিন রাতে দেখেছিলো। ঘাড় কাত করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিলির দিকে। মিলি কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মা তার নিজের রুমে। নিজ হাতে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়েছে উনাকে। কাজের মেয়েটা অবসর সময়ে ঘুমুচ্ছে। বিশাল বাড়িতে সে একা। মিলি তাড়াহুড়া না করে আস্তে আস্তে করে মাথা ঘুরাল। দিনের আলো কিছুটা শক্তি দিচ্ছে তাকে। কম্পিউটার টেবিলের পাশেই কাগজ চাপা দেয়ার জন্য একটা ভারী পাথর রাখা। এক হাতে শক্ত করে তা চেপে ধরল।

মাথা ঘুড়িয়ে তার থেকে ৫-৬ হাত পেছনেই মেয়েটাকে দেখতে পেল মিলি। দিনের আলোতে তাকে দেখে তেমন ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। উল্টা কেমন যেনও অসহায় লাগছে মেয়েটাকে। মিলি কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বুঝার চেষ্টা করলো তার এখন কি করনীয়। মেয়েটি এক জায়গায় ঠায় দাড়িয়ে আছে। নড়ছে না। মিলি চেয়ারে বসে থেকেই জিজ্ঞেস করলো, “কে তুমি? কি চাও আমার কাছে? কেন ভয় দেখাচ্ছ আমায়?”

জবাবে মেয়েটা কিছু না বলে এক পা এগিয়ে এলো। ঘন কালো চুলের পিছন থেকে কালো চোখগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে একই সাথে বিরাজ করছে প্রচণ্ড ঘৃণা এবং হতাশা। মিলি নিজের উপর কন্ট্রোল রাখার চেষ্টা করলো। মেয়েটা এগিয়ে এলেও সে ভয় না পেয়ে পুনরায় একই কথা জিজ্ঞেস করলো।
“তুমি চাইলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। আমরা বন্ধু হতে পারি। আমি তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না। তুমি কোথা থেকে আসো কোথায় যাও তার কিছুই আমার জানা নেই, তবে তুমি যদি আমাকে কিছু বলতে চাও তাইলে নির্দ্বিধায় বলতে পারো। আমার আয়ত্তে থাকলে আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করবো।”

মেয়েটা এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছিলো। কিন্তু মিলির এই কথা শোনার সাথে সাথে আবার থেমে গেলো। খানিকক্ষণ থেমে থেমে মিলিকে পরখ করলো যেনও। এরপর সেদিনের মতো এক হাত বাড়িয়ে দিলো মিলির দিকে।

হাতটার দিকে তাকিয়ে একই সাথে ভয় এবং কৌতূহল কাজ করা শুরু করলো মিলির ভেতরে। সেদিন রাতেও মেয়েটি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলো দেখে সেই হাত ধরতে পারে নি। তার কি উচিত হবে মেয়েটার হাত ধরা? মেয়েটাকে সে চিনে না। কিন্তু কেনও যেনও তার মনে হচ্ছে মেয়েটা তাকে কিছু বলতে চায়। এখনো পর্যন্ত মেয়েটা তার কিছু ক্ষতি করে নি, কিন্তু নিশ্চিত হবার চান্স নেই যে সে ভবিষ্যতেও কোনও ক্ষতি করবে না। মিলি খুব একটা সাহসী কখনোই ছিল না। কিন্তু নিজের মধ্যে এক অদম্য ইচ্ছা জাগ্রত হল তার। এগিয়ে গিয়ে ধরে ফেলল মেয়েটির বাড়ানো হাতখানা!

(চলবে)

No comments:

Post a Comment