Responsive Ads Here

18 January 2012

ভুতুরে গল্প-২

সকাল ১০ টা।

সুলতান সাহেব আজকে অফিসে যান নি। সকালে নামাজ পড়তে উঠার পর মিলির ঘরে এসেছিলেন তিনি মিলিকে দেখার জন্য। দেখতে পান মাটিতে পড়ে আছে মিলি। গালে একটা অদ্ভুত নিশানা। অনেকটা গালে ধারালো নখ দিয়ে আঁচড় কাটলে যেমন হয়। অনেক চেষ্টার পর মিলির জ্ঞান ফিরে। কিন্তু জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে সুলতান সাহেবকে আঁকড়ে ধরে সে। বলতে থাকে, “ভয় পেয়েছি বাবা। ভীষণ ভয় পেয়েছি।”

সুলতান সাহেব এবং মিলির মা মমতাজ বেগম অনেক চেষ্টা করেও তাকে সাহস দিতে পারেননি। মিলি বারবার বলতে থাকে, এই বাড়িতে সে থাকবে না। সুলতান সাহেব পড়েছেন বিপদে। আজকে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিঙে এটেণ্ড করার কথা। কিন্তু মিলিকে এই অবস্থায় ফেলে যাওয়া সম্ভব না। অগত্যা, মিলির ছোট মামাকে খবর দিয়েছেন তিনি। মিলি উনার সাথে অনেক ফ্রি। যদি কিছু বলে, সেই আশায়।

খবর পেয়েই মিলির ছোট মামা ছুটে আসেন। মিলি ছোট মামাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। কেন জানি, ছোট মামাকে তার খুব আপন মনে হয়। অন্যরা যেখানে তাকে ছোট বাচ্চা বলে অবহেলা করে বা তার কথাটা বিশ্বাস করতে চায় না, সেখানে ছোট মামাকে যেকোনো কথা বললেই তিনি তা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেন। ছোট মামাকে নিয়ে নিজের রুমে যায় সে। সব খুলে বলে গতরাতে যা যা হয়েছে।

মিলির ছোট মামা, সেলিম তালুকদার পেশায় একজন ডাক্তার। ১০ বছর ধরে ডাক্তারি করছেন। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে মিলির কথাগুলো শুনলেন। বিশ্বাস করলেন কি করলেন না, তা তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল না। তিনি তার ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, যখন কারো মন কোনও ব্যাপারে বিক্ষিপ্ত থাকে তখন তাকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া উচিত। এতে বিক্ষিপ্ত ভাবটা অনেকটাই কেটে যায়। মিলির দেখানো স্থানটা একটু নিজে দেখবেন বলে মিলির বিছানার দিকে গেলেন তিনি। সকালে সবাই মিলিকে নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল তাই বিছানা গোছানো হয়নি। ছোট মামা মিলির হাত অনুসরণ করে সেখানটায় গেলেন যেখানে গত রাতে মেয়েটিকে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিলো। কাঁথার পাশে কি যেনও একটা লেগে আছে। ছোট মামা আর একটু এগিয়ে গিয়ে জিনিসটা হাতে তুলে নিলেন। এক গাছি চুল। খুব সুন্দর চুল। ঘন কালো এবং সিল্কি। মিলির চুল হতেই পারে না। কারন তার ভাগ্নির চুল একটু লালচে আর কোঁকড়া।

বড় মামা নিজের হাতের তালুতে চুলের গাছিটা লুকিয়ে ফেললেন। পাছে মিলি আবার কি না কি ভেবে বসে। মিলিকে নিয়ে বারান্দায় চলে এলেন তিনি। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন মিলির বাবা এবং মা।

সুলতান সাহেব মিলির ছোট মামাকে নিয়ে আড়ালে গিয়ে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। ঘটনা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তোমার কি মনে হয় সেলিম, ঘটনা কি??”

সেলিম সাহেব সরাসরি কোনও উত্তর দিলেন না। একটু ঘুরিয়ে বললেন, “নতুন বাসা, প্রথম রাত। হয়তো ভুলভাল দেখেছে। আপনি চিন্তা করবেন না দুলাভাই। আমি মাঝে মাঝে কাজ কম থাকলে চলে আসবো এইখানে। মিলির সাথে গল্পগুজব করবো। তাহলে হয়তো মিলি একজন কথা বলার মানুষ খুঁজে পাবে। একজন সঙ্গি পেলেই এইসব ঠিক হয়ে যাবে।”

“তুমি একটু দেখো সেলিম। আমার একমাত্র মেয়েটার জন্য আমার অনেক চিন্তা হয়।” মনে মনে বিড়বিড় করে বললেন সুলতান সাহেব।

সেলিম সাহেব মিলিদের বাসা থেকে বের হবার সাথে সাথে হটাত আকাশটা পুরো অন্ধকার হয়ে গেলো। এমনটা হবার কোনও কারণ ছিল না। কারণ সময় এখন বিকেল ৩ টা। রোদ ঝলমলে একটা দিন এমন করে মিনিটের মধ্যে আধারে ঢেকে যাবে এটা খানিকটা অবিশ্বাস। সেলিম সাহেব কিঞ্চিৎ ভয় পেলেন। বৃষ্টি নামলে এই এলাকার রাস্তাঘাট কাঁদায় সয়লাব হয়ে যায়। জামা কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে।

বলা নেই কওয়া নেই, ঝুমঝুম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। উপায়ন্তর না দেখে সেলিম সাহেব একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিলেন। পুরানো আমলের গাছ। বিশাল মোটা কাণ্ড। শুধু যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাই না, পাল্লা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। ব্যাপারটা কিছুতেই বোধগম্য হল না সেলিম সাহেবের কাছে। এই অসময়ে বৃষ্টি, তার উপর এমন ঝড়ো হাওয়া। নাহ, কোথায় কি যেনও একটা গোলমাল আছে।

গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মধ্যে মিলিদের বাড়ির দিকে তাকালেন সেলিম সাহেব। এই মফঃস্বল শহরে আসার পর থেকেই এই বাড়ি সম্পর্কে অনেক অদ্ভুত ব্যাপার শুনেছেন তিনি। কখনো বিশ্বাস হয় নি ঘটনা। অনেকেই নাকি বাড়িটাতে রাতের বেলা একটা বাচ্চা মেয়েকে ঘুরতে দেখে। মেয়েটার পড়নে থাকে একটা সাদা ময়লা পোশাক, মাথার চুল নাকি অনেক লম্বা। পুরো মুখটাকেই ঢেকে দিয়েছে সেই চুল। মেয়েটাকে যারা দেখেছে তাদের সাথে ১ সপ্তাহের মধ্যেই কোনও না কোনও বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাদের বেশিরভাগই অপঘাতে মারা গেছে নয়ত কাউকে কিছু না বলে হারিয়ে গেছে শহর থেকে। যারা বেঁচে আছে তাদের মধ্যে পাগল হয়ে গেছে কয়েকজন, আর কয়েকজন এই জায়গা ছেড়ে বহু দূরে পালিয়েছে।

পুরনো ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাড়িটা ইংরেজদের আমলে একপ্রকার টর্চার হাউজের মতো ছিল। কোনও প্রজা খাজনা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বা আইন ভঙ্গ করলে এই বাড়িতে এনে অত্যাচার করা হতো। এই বাড়িতে বেগোড়ে প্রান দিতে হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। শুধু যে প্রজাদের অত্যাচার করা হতো তাই নয়, এমনকি মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে মেয়ে মানুষ ধরে এনে তাদের উপর চরাও হতো ঐ পশুগুলো। বেশীরভাগই সহ্য করতে না পেরে মারা যেতো। দাফনকাফনের ঝামেলায় না গিয়ে সেই লাশগুলোকে ফেলে দেয়া হতো বাড়ির পিছনে কুয়োতে। সেই কুয়াকে ঘিরেও লোকমুখে নানান কথা শোনা যায়। যদিও কুয়াটা পরে মাটি ফেলে বন্ধ করে দেয়া হয় তবে প্রবীণ বৃদ্ধ যারা আছেন তাদের মুখে মুখে এককালে নাকি এইসব ঘটনা শোনা যেতো। তবে মানুষ এখন অনেক উন্নত। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা চারিদিকে। এখন ঐ পুরনো আমলের কথা ভেবে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। তাই এখন এসব নিয়ে আলোচনা প্রায় হয় না বললেই চলে। একবার তিনি ভেবেছিলেন সুলতান সাহেবকে জানাবেন এই ঘটনাগুলো সম্পর্কে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হয়েছে, কি লাভ জনিয়ে? তিনি নিজেই যেখানে এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না সেখানে আরেকজনকে ভয় দিয়ে লাভটাই বা কি?

বৃষ্টির প্রকোপ বেড়েই চলছে। সেলিমক সাহেব নিজের ঘড়িটার দিকে একবার চোখ বুলালেন। বিকেল ৩.৪৫! এই অসময়ে এমন বৃষ্টির কোনও মানে হয় না। উনি এই সময়ে প্রতিদিন চেম্বারে বসেন। চেম্বারে যদি তিনি না থাকেন তবে রুগীরা এসে ঘুরে যাবে। দিনটাই বৃথা যাবে তার।

ঘড়ি থেকে চোখ তুলে আবারো বাড়িটার দিকে তাকালেন তিনি। সাথে সাথে বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো। ২ তালা বাড়িটার ছাদে ঠিক রেলিং এর পাশ ঘেঁষে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরের গড়ন দেখে বুঝা যাচ্ছে বয়স ১২-১৪ এর মধ্যে হবে। মেয়েটার সাদা জামাটি বৃষ্টিতে ভিজে গায়ের সাথে লেপটে আছে। মাথার চুল ঘন কালো। সেই চুল মেয়েটির মুখের সামনের দিকে দেয়া। তাই পুরো মুখটাই ঢাকা পরে আছে সেই চুলের আড়ালে। সেলিম সাহেব তাকানো মাত্রই মেয়েটি রেলিং এর উপর উঠে গেলো। সেলিম সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখলেন মেয়েটি রেলিং এর উপর দিয়ে হাঁটছে। একে তো শ্যাওলা পড়া পুরনো বাড়ি তার উপর বৃষ্টি। যেকোনো সময় বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। সেলিম সাহেবের দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। তিনি বৃষ্টির পরোয়া না করে ছুট লাগালেন বাড়িটির দিকে। যেভাবেই হোক মেয়েটার পতন ঠেকাতে হবে। নিজের চোখের সামনে একটা বাচ্চা মেয়ের মৃত্যু দেখতে পারবেন না তিনি।

গাছের আড়াল থেকে বের হতেই সেলিম সাহেবের গা বৃষ্টির ঝাঁপটায় ভিজে গেলো। ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শে কেঁপে উঠলো শরীরটা। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে এতো ঠাণ্ডা বাতাসসহ বৃষ্টি তিনি জীবনে দেখেন নি। মিলিদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে ছিল না গাছটা। ২০-২৫ সেকেন্ডের মধ্যেই মেইন গেটের কাছে চলে আসলেন সেলিম সাহেব। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। উপরের দিকে তাকাতেই দেখলেন পা হড়কাল মেয়েটি। পড়তে শুরু করলো নিচের দিকে। সেলিম সাহেবের চোখের সামনে বাড়ির সামনের লনে আছড়ে পড়লো দেহটি।

সেলিম সাহেব কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর একটু একটু করে এগুতে লাগলেন মেয়েটির দিকে। কিছুটা দূরে হলেও তিনি স্পষ্ট শুনেছিলেন বেকায়দা মতন পড়ে মেয়েটির ঘাড়ের হাড্ডি ভেঙ্গে যাওয়ার শব্দ। “খট” করে একটা আওয়াজ এসে ধাক্কা মেরেছিল তার কানে। একজন পেশাদার ডাক্তার তিনি। যা বুঝার বুঝে নিয়েছিলেন। ভুল হবার প্রশ্নই আসে না। আর ঘাড়ের হাড্ডি ভেঙ্গে যাওয়া মানে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু।

ধীর পায়ে হেঁটে মেয়েটির লাশের পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি। এখনো মুখটা ঢেকে আছে চুল দিয়ে। একটা হাত বুকের উপর, আরেকটা ছড়িয়ে আছে দেহের পাশে। সেলিম সাহেব খানিকটা ঝুঁকে এলেন। ইচ্ছে চুল গুলো সরিয়ে মেয়েটির মুখ শেষবারের মতন দেখা।

সেলিম সাহেব ঝুঁকা মাত্রই মেয়েটি যন্ত্রের মতো সোজা হয়ে বসে গেলো এবং বুকের কাছে রাখা হাতটি দিয়ে সেলিম সাহেবের গলার একপাশটা চেপে ধরল। চমকে উঠলেন সেলিম সাহেব মেয়েটির হাতের স্পর্শ পেয়ে। আগুনের মতো গরম সেটি। মনে হল, আগুনে লাল করা কোনও লোহা যেনও লাগিয়ে দেয়া হল তার গলায়। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো এক গগনবিদারি চিৎকার। ব্যাথা সহ্য করতে পারলেন না তিনি। অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।

(চলবে)

No comments:

Post a Comment