অন্ধকারে আস্তে আস্তে চোরের মতো বেয়ে উঠলাম দোতলার সেই বারান্দাটিতে।
ধনী লোকদের বাড়িগুলোর ডিজাইন যতই সুন্দর হোক না কেন, চোরদের চুরি করবার জন্য বেশ আদর্শের। বারান্দা বা জানালাগুলো বেশিরভাগ কেমন খোলামেলা হয়ে থাকে। আর দোতলা বারান্দায় উঠা কি এমন কাজ। চোরেরা এমন সব বাড়িতে কেন হানা দেয় না ঠিক বুঝিনা। বিদেশী কুকুরগুলো যতই হুমহাম করুক না কেন,আমাদের দেশের বাতাসের সংস্পর্শে এসে সবই ন্যাতা মেরে যায়। আর একজন দু'জন সিকিউরিটি গার্ডকে ফাঁকি দেয়া কি এমন কাজ। যাই হোক, চোরদের ভাল চিন্তা না করি আমি। যে কাজে এসেছি সেটা করেই না হয় বিদেয় নেই। শত হলেও ভালবাসার প্রমাণ বলে কথা। এই প্রমাণের জন্যই কিনা আজ এই চৌর্যবৃত্তি। নাহ,চৌর্যবৃত্তি কথাটা মানাচ্ছে না।
এখন বলি আসল ঘটনা। আমি ফারায।
একজনকে পছন্দ করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনটি হতেই। ঘুরে বেড়াতাম তার খোঁজে নানান ডিপার্টমেন্টে। কারণ, প্রথম দিন দেখা হয় নবীন বরণে, তখন তো আর জানা যায় নি কোন বিভাগের ছাত্রী সে।
যখন তার খোঁজ পেলাম, জানলাম দুই দুই বছরের সিনিয়র আমার থেকে, অসম্ভব মেধাবী ছাত্রী। আর আমি?কোনো মতে টেনেটুনে এইচএসসি পাশ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। কি করে চান্স পেলাম এমন একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে তা আজো আমার নিকট রহস্যময় হয়ে থাকলো। তার নামটি ছিল তাহযিব। আশেপাশের সবাই বলতো তাযিব, আর আমি বলতাম তাবিজ। প্রথম প্রথম তার অপেক্ষায় ক্যান্টিনে বসে থাকা হা করে। এরপর একটু একটু কথা। একটু একটু ফোনে আলাপ। বয়সে বড় হবার কারণে আপু সম্বোধন করে কথা বলতাম। কিন্তু মনে মনে শুধু বলতাম তাহযিব, তাহযিব আর তাহযিব।
এভাবেই সময় চলেছিল।
একদিন ধুম করে জানিয়ে দিলাম, তাকে ভালবাসি আমি, অনেক অনেক অনেক।
বয়স তখন অল্প আমার, কোনো কিছুর ঠিক ঠিকানা নেই। কিভাবে কি করতে হয়, কিভাবে কি বলতে হয় কোনো কিছুরই ঠিক নেই আমার। যেটা মনে আসলো, বলে দিলাম। একদিন তাহযিবের সরাসরি হুমকি। তার পেছনে ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে পড়াশুনাতে মন দিতে হবে। আমার উত্তর ছিল যে, তার ভালবাসা পেলে শুধু পড়াশুনাতে নয়, সবকিছুতেই মন দেবো, অতিব ভ্দ্র ছেলে হয়ে যাবো ইত্যাদি ইত্যদি। কে শোনে কার কথা,গটগট করে হেঁটে চলে গেলো সামনে থেকে। মাঝে মাঝে কথা হতো ফোনে, কিন্তু দুই কি তিন মিনিট। আর এসএমএস দিলে তো কোনো উত্তর কোনোদিনও পাইনি। আজ রাতে হুট করে বরে বসলাম কি করলে তার মন পাও্য়া যাবে? উত্তর ছিল, সাহস থাকলে যেন তার বাড়ির বারান্দার সামনে দাঁড়াই রাত ৩টা বাজে। সাথে সাথে বুক চিতিয়ে মেনে নিলাম তার এই কথা, প্রমাণ হয়ে যাবে আজ রাতে একটা কিছু। যার দরুন আমি এখন তাহযিবের বারান্দায়। বিশাল উঁচু দেয়াল টপকে, বাড়ির পেছনের ঝোঁপ পাড় হয়ে নিশ্চিত হয়েছিলাম যে কুকুর দু'টো ছাড়া নেই। আর সামনের দিকে রয়েছে সিকিউরিটি গার্ড। এমন হাস্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে তো মনে মনে হেসেছিলাম আবার সৃষ্টিকর্তার নিকট শোকরিয়াও আদায় করলাম অবস্থা আমার অনুকূলে দেখে। মানুষ তার ভালবাসার জন্য কি না করে, ভাবলাম মনে মনে। নিজেকেই নিজে পিঠ চাঁপড়ে দিতে মন চাইলো এই বাহাদুরী দেখে।
তাহযিবের ঘুম বেশ পাতলা।
একটু শব্দেই ঘুম ভাঙ্গে তার। মোবাইলের টুংটাং শব্দে লাফিয়ে উঠলো সে, এতরাতে তাকে কেউ ফোন দেয় না সহজে। মোবাইলটা কানে ধরতেই ফারাযের শিশুদের মতো উল্লাস,
কাঁচের দরজাটা একপাশে টানতেই চমকে উঠলো তাহযিব।
তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফারায!
তাহযিব আস্তে করে চলে অন্ধকারের কোথাও কোনো সুইচ চাপতেই হলদে ম্রিয়মান এক আলো জ্বলে উঠলো ঘরের এক কোণে।
দ্রুততার সাথে দু'টো প্লেটের সবটুকু খাবার খেয়ে সাবাড় করলো ফারায, আর তাহযিব অবাক হয়ে তার কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে।
ভোরের আলো ফুটে উঠতে থাকে।
ফারায রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে চলে যায়। নিজের মনেরই অজান্তে হেসে ফেলে তাহযিব। ছেলেটার পাগলামি মাঝে মাঝে খুব মন ছুঁয়ে যেতে চায়। তবুও নিজেকে অবাধ্য হতে দেয় না সে। ছেলেটি অনেক ভালবাসে, কিন্তু এই ভালবাসা কি থাকবে চিরটা কাল? হয়তো বা এখন বয়স অল্প বলে তার কাছে সব রঙীন। একদিন কি সব সাদাকালো হয়ে যাবে না কে জানে? অচেনা এক রিংটোন শুনে অবাক হয়ে রুমে ফিরে আসে তাহযিব। দেখে তার বিছানার এক কোণে পড়ে আছে ছোটখাট এক মোবাইল সেট। সেটাতেই রিং হচ্ছে, ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে ফারাযের নাম। আসতে করে হাতে তুলে নেয়, রিসিভ করতেই শুনতে পায় ফারাযের কন্ঠ।
সেদিনের সকালটা শুরু হয়েছিল তাহযিবের ভালবাসার কিছু লেখা দিয়ে।
হোক না সেটা এসএমএসের আকারে। অনেক অনেক মেসেজ ছিলো সেখানে। সব পড়েছিল তাহযিব। চোখে ভাসছিল একটি মেসেজের লাইন,
“ আপনাকে কত ভালবাসি জানিনা, তবে, আপনাকে পেয়ে আমি হারাতে চাই না। আমার বিশ্বাস আপনি আমার কাছে আসবেন। হয়তো বা কোনো এক বিকেলে। হয়তো বা এক বর্ষার সন্ধ্যায়। হয়তো বা কোনো এক কুয়াশা ভেজা ভোরবেলায়। প্রকৃতির সব রূপে আপনাকে দেখতে চাই, সব সময় আপনাকে ভালবাসতে চাই। সূর্য যখন অস্ত যাবে, দিগন্ত দেখবো তখন আমি আপনার চোখের কাজলে। আর যখন উদয় হবে, তখন আপনার চোখের মণিতেই আমি খুঁজে পাবো নতুন সূর্যের”
কেন যেন এই লাইন ক 'টি পড়ে তাহযিবের চোখের কোণে পানি চলে আসে।
টপটপ করে অশ্রুর ফোঁটা পড়ে যায় মোবাইলের স্ক্রীণে। নিজের মনের ভেতর কি চলেছে বুঝতে পারছেনা সে। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে তার নিজেকে।
এরপর.....।
এরপর সময় ছিল দু'জনের কাছে আসার।
কি বর্ষা বা ঝড়, ফারায ঠিক মাঝরাত্রীতেই দাঁড়িয়ে থাকতো তাহযিবকে শুধু এক পলক দেখবার। একটু দেখেই চলে যেতো হেঁটে একাকী সে রাস্তায়। তার হাঁটাতেও যেন ছিল অদ্ভুত এক মায়া। নয়তো কি আর তাহযিব বারান্দা থেকে চেয়ে থাকতো সেই বাউন্ডুলে ছেলেটির চলে যাবার দিকে। কুয়াশার ভেজা ভোরে যখন প্রকৃতি থাকতো ঘুমিয়ে, ঠিক তখনও ফারায দাঁড়িয়ে রইত দূর এক কোণে। তাহযিবকে বারান্দায় দেখেই একা হেসে মনের আনন্দে চলে আসতো।
এভাবেই ছিল সময়, সব ছিল।
মাঝে মাঝে আমি যখন মাঝরাতে দাঁড়াই বারান্দায়, দেখতে পাই ফারাযকে।
চুপিচুপি বাড়ি হতে পালিয়ে রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তার প্রিয় মানুষকে এক পলক দেখবার জন্য। কত দুরন্ত যে ছিল! একটু পর সব মিলিয়ে যায়।
মাঝে মাঝে এক রাস্তার পাশে দাঁড়ালে দেখতে পাই তাদের দু'জনকে।
তাহযিব বারান্দায় দাঁড়িয়ে, ফারায রাস্তায় চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যেন চোখের ইশারায় কথা বলে যায়। হাত নেড়ে হেঁটে চলে যায় ফারায অন্ধকারের মাঝে। আস্তে করে চোখের সামনে হতে তাহযিবও মিলিয়ে যায়, মিলিয়ে যায় ফারায। শূন্য বারান্দায় তখন কেউ থাকেনা, শূন্য পথে কেউ হেঁটে আর যায় না বাউন্ডুলেপনায়।
সব ভেসে উঠে দু'নয়নে। ভাল লাগে দৃশ্যগুলো কল্পনা করতে।
অনেক অনেক ভাল লাগে.................
লিখেছেন- Daif MD Samrat
ধনী লোকদের বাড়িগুলোর ডিজাইন যতই সুন্দর হোক না কেন, চোরদের চুরি করবার জন্য বেশ আদর্শের। বারান্দা বা জানালাগুলো বেশিরভাগ কেমন খোলামেলা হয়ে থাকে। আর দোতলা বারান্দায় উঠা কি এমন কাজ। চোরেরা এমন সব বাড়িতে কেন হানা দেয় না ঠিক বুঝিনা। বিদেশী কুকুরগুলো যতই হুমহাম করুক না কেন,আমাদের দেশের বাতাসের সংস্পর্শে এসে সবই ন্যাতা মেরে যায়। আর একজন দু'জন সিকিউরিটি গার্ডকে ফাঁকি দেয়া কি এমন কাজ। যাই হোক, চোরদের ভাল চিন্তা না করি আমি। যে কাজে এসেছি সেটা করেই না হয় বিদেয় নেই। শত হলেও ভালবাসার প্রমাণ বলে কথা। এই প্রমাণের জন্যই কিনা আজ এই চৌর্যবৃত্তি। নাহ,চৌর্যবৃত্তি কথাটা মানাচ্ছে না।
এখন বলি আসল ঘটনা। আমি ফারায।
একজনকে পছন্দ করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনটি হতেই। ঘুরে বেড়াতাম তার খোঁজে নানান ডিপার্টমেন্টে। কারণ, প্রথম দিন দেখা হয় নবীন বরণে, তখন তো আর জানা যায় নি কোন বিভাগের ছাত্রী সে।
যখন তার খোঁজ পেলাম, জানলাম দুই দুই বছরের সিনিয়র আমার থেকে, অসম্ভব মেধাবী ছাত্রী। আর আমি?কোনো মতে টেনেটুনে এইচএসসি পাশ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। কি করে চান্স পেলাম এমন একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে তা আজো আমার নিকট রহস্যময় হয়ে থাকলো। তার নামটি ছিল তাহযিব। আশেপাশের সবাই বলতো তাযিব, আর আমি বলতাম তাবিজ। প্রথম প্রথম তার অপেক্ষায় ক্যান্টিনে বসে থাকা হা করে। এরপর একটু একটু কথা। একটু একটু ফোনে আলাপ। বয়সে বড় হবার কারণে আপু সম্বোধন করে কথা বলতাম। কিন্তু মনে মনে শুধু বলতাম তাহযিব, তাহযিব আর তাহযিব।
এভাবেই সময় চলেছিল।
একদিন ধুম করে জানিয়ে দিলাম, তাকে ভালবাসি আমি, অনেক অনেক অনেক।
বয়স তখন অল্প আমার, কোনো কিছুর ঠিক ঠিকানা নেই। কিভাবে কি করতে হয়, কিভাবে কি বলতে হয় কোনো কিছুরই ঠিক নেই আমার। যেটা মনে আসলো, বলে দিলাম। একদিন তাহযিবের সরাসরি হুমকি। তার পেছনে ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে পড়াশুনাতে মন দিতে হবে। আমার উত্তর ছিল যে, তার ভালবাসা পেলে শুধু পড়াশুনাতে নয়, সবকিছুতেই মন দেবো, অতিব ভ্দ্র ছেলে হয়ে যাবো ইত্যাদি ইত্যদি। কে শোনে কার কথা,গটগট করে হেঁটে চলে গেলো সামনে থেকে। মাঝে মাঝে কথা হতো ফোনে, কিন্তু দুই কি তিন মিনিট। আর এসএমএস দিলে তো কোনো উত্তর কোনোদিনও পাইনি। আজ রাতে হুট করে বরে বসলাম কি করলে তার মন পাও্য়া যাবে? উত্তর ছিল, সাহস থাকলে যেন তার বাড়ির বারান্দার সামনে দাঁড়াই রাত ৩টা বাজে। সাথে সাথে বুক চিতিয়ে মেনে নিলাম তার এই কথা, প্রমাণ হয়ে যাবে আজ রাতে একটা কিছু। যার দরুন আমি এখন তাহযিবের বারান্দায়। বিশাল উঁচু দেয়াল টপকে, বাড়ির পেছনের ঝোঁপ পাড় হয়ে নিশ্চিত হয়েছিলাম যে কুকুর দু'টো ছাড়া নেই। আর সামনের দিকে রয়েছে সিকিউরিটি গার্ড। এমন হাস্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে তো মনে মনে হেসেছিলাম আবার সৃষ্টিকর্তার নিকট শোকরিয়াও আদায় করলাম অবস্থা আমার অনুকূলে দেখে। মানুষ তার ভালবাসার জন্য কি না করে, ভাবলাম মনে মনে। নিজেকেই নিজে পিঠ চাঁপড়ে দিতে মন চাইলো এই বাহাদুরী দেখে।
তাহযিবের ঘুম বেশ পাতলা।
একটু শব্দেই ঘুম ভাঙ্গে তার। মোবাইলের টুংটাং শব্দে লাফিয়ে উঠলো সে, এতরাতে তাকে কেউ ফোন দেয় না সহজে। মোবাইলটা কানে ধরতেই ফারাযের শিশুদের মতো উল্লাস,
- - হে হে হে, বারান্দার দরজাটা খুলবেন কি?
কাঁচের দরজাটা একপাশে টানতেই চমকে উঠলো তাহযিব।
তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফারায!
- তুমি? এখানে? চাপা এবং ভীত স্বরে তাড়াতাড়ি বললো সে।
- আপনি না বললেন আপনার বারান্দার সামনে দাঁড়াতে?
- উফফ, আস্তে বলো, কেউ শুনবে। ওহ খোদা আমি কি করবো একে নিয়ে। তুমি..তুমি যাও।
- পারবোনা।
- প্লিজ বলছি, কেউ দেখে ফেলবে।
- না দেখলেও এখন দেখবে। কারণ আমি আপনার মেইন গেট দিয়েই পাড় হবো। তখন বুঝবেন ঠ্যালা।
- ইয়া খোদা, আমি কি করি। তুমি নিচু হয়ে বসো।
- বসলাম, বলে ফারায অন্ধকারেই বসে পড়ে তাহযিবের বারান্দায়।
-
-
- তুমি ভেতরে আসো। বেশি না, ব্যস, হ্যাঁ অতটুকু হলেই চলবে। আল্লাহই জানেন কেউ দেখেছে কিনা।
-
- এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ঘরে টেবিল ল্যাম্প নেই? একটু জ্বালুন না। কিছুটা তো আলো হয়ে থাক।
- তুমি কি বুঝতে পারছো কেউ যদি জানে ঘটনাটা কি অবস্থা হবে তোমার? তাহযিব বেশ ক্ষেদের সাথে বলে।
- আরে কেউ তো টের পায়নি। আপনি একটু শান্ত হোন।
তাহযিব আস্তে করে চলে অন্ধকারের কোথাও কোনো সুইচ চাপতেই হলদে ম্রিয়মান এক আলো জ্বলে উঠলো ঘরের এক কোণে।
- বাহ, আপনার রুম তো অনেক বড় আর সুন্দর। আসলে বড়লোকদের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। বলে হাসে ফারায।
- কি চিন্তা করছেন? আরে বাবা এত ভয়ের কিছু নেই। কেউ কিচ্ছু দেখেনি। চোরের মত এসেছি, চোরের মতই চলে যাব। পড়ে শুনাবো কিভাবে দোতালায় উঠলাম। তবে বেশ খাঁটুনি গিয়েছে, ঘরে খাবার কিছু আছে কি? ক্ষিদে পেয়েছে আমার অনেক। পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বাচ্চাদের মতো করে বলে ফারায।
- তুমি খুব আনন্দে আছো মনে হয়?
- হে হে হে, আপনি না বললেন রাত ৩টায় বারান্দার সামনে দাঁড়াতে? আমি তো সরাসরি বারান্দাতেই আসলাম।
-
- কিছু দিন না খেতে? খুব খিদে পেয়েছে। আমার আবার রাতে খুব খিদে পায়। এমন করে বলে ফারায, তাহযিব উঠে আস্তে করে দরজা খুলে বাইরে গেল। তবে যাবার আগে বাতি নেভাবে ভুললো না।
-
- আরে সাবাশ! পাটিসাপ্টা পিঠা ! আমার ফেবারিট জিনিস!
- উফফ, আস্তে গাধা। কেউ শুনে ফেলবে। তাহযিবের চাপা স্বর।
- আরে, পেস্ট্রিও আছে দেখি। ইয়ামী ইয়ামী! ফারায এবার আস্তে বলে।
- এগুলো খেয়ে আমায় উদ্ধার করে বিদেয় হও গাধা।
- আর আমার উত্তর? বলে গপগপ করে খাওয়া শুরু হলো ফারাযের।
- কিসের উত্তর?
- আমি যে আপনাকে ভালবাসি।
- উত্তর হলো, না।
- এটা কেমন কথা? আপনি না বললেন রাত ৩টায় বারান্দায় দাঁড়ালে.........
- চুপপ! একদম চুপপ!
দ্রুততার সাথে দু'টো প্লেটের সবটুকু খাবার খেয়ে সাবাড় করলো ফারায, আর তাহযিব অবাক হয়ে তার কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে।
-
-
- এক মগ কফি খাওয়াবেন আপু? দেয়ালে আধো কাত হয়ে চরম আরামে শুয়ে আবদার করলো ফারায।
-
-
-
-
-
- সাবাশ! একা একা কফি খাওয়ার চেয়ে দু'জন মিলে খাওয়া ভাল।
- চুপচাপ কফি খেয়ে বিদায় নেবে ফারায।
- জ্বি ম্যাডাম, সেটাই করবো।
- আরেকটা কথা হলো, আর ভুলেও এমন করবেনা। কখন কি হয় বলা যায় না। সমস্যা তোমার হবেনা। হবে আমার, আমি শত হলেও মেয়ে। একটি মেয়ের বারান্দায় রাতে বেয়ে উঠা কি ঠিক?
- আপনিই তো বললেন।
- আমি বললেই করবে সব?
- হুমম, করবো?
- তাহলে আপাতত ভাগো, আর এমন করবে না। অল্প বয়স হলে যা হয়,তোমার সেটাই হচ্ছে।
- এই যে, এত অল্প বয়স অল্প বয়স করবেননা তো। মেজাজ খারাপ হয়।
- চুপপ! একদম চুপপ!
-
-
-
ভোরের আলো ফুটে উঠতে থাকে।
ফারায রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে চলে যায়। নিজের মনেরই অজান্তে হেসে ফেলে তাহযিব। ছেলেটার পাগলামি মাঝে মাঝে খুব মন ছুঁয়ে যেতে চায়। তবুও নিজেকে অবাধ্য হতে দেয় না সে। ছেলেটি অনেক ভালবাসে, কিন্তু এই ভালবাসা কি থাকবে চিরটা কাল? হয়তো বা এখন বয়স অল্প বলে তার কাছে সব রঙীন। একদিন কি সব সাদাকালো হয়ে যাবে না কে জানে? অচেনা এক রিংটোন শুনে অবাক হয়ে রুমে ফিরে আসে তাহযিব। দেখে তার বিছানার এক কোণে পড়ে আছে ছোটখাট এক মোবাইল সেট। সেটাতেই রিং হচ্ছে, ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে ফারাযের নাম। আসতে করে হাতে তুলে নেয়, রিসিভ করতেই শুনতে পায় ফারাযের কন্ঠ।
- দুঃখিত, আপনার ওখানে আমার সেটটা ভুলে রেখে এসেছি।
- এখন তো তোমার সেট থেকেই ফোন দিয়েছো তাই না?
- হে হে হে।
- মানে ইচ্ছে করে এই সেটটা রেখে গিয়েছো তাই তো? কেন বলতো?
- সেটের মেসেজ অপশনের ড্রাফটে যাবেন প্লিজ। সেখানে কিছু লেখা আছে এসএমএস আকারে। আপনাকে দেয়া হয়নি কখনও। কিন্তু আপনাকেই ভেবে প্রতিনিয়ত লেখা। পড়বেন আশাকরি, বলেই লাইন কেটে দিল ফারায।
সেদিনের সকালটা শুরু হয়েছিল তাহযিবের ভালবাসার কিছু লেখা দিয়ে।
হোক না সেটা এসএমএসের আকারে। অনেক অনেক মেসেজ ছিলো সেখানে। সব পড়েছিল তাহযিব। চোখে ভাসছিল একটি মেসেজের লাইন,
“ আপনাকে কত ভালবাসি জানিনা, তবে, আপনাকে পেয়ে আমি হারাতে চাই না। আমার বিশ্বাস আপনি আমার কাছে আসবেন। হয়তো বা কোনো এক বিকেলে। হয়তো বা এক বর্ষার সন্ধ্যায়। হয়তো বা কোনো এক কুয়াশা ভেজা ভোরবেলায়। প্রকৃতির সব রূপে আপনাকে দেখতে চাই, সব সময় আপনাকে ভালবাসতে চাই। সূর্য যখন অস্ত যাবে, দিগন্ত দেখবো তখন আমি আপনার চোখের কাজলে। আর যখন উদয় হবে, তখন আপনার চোখের মণিতেই আমি খুঁজে পাবো নতুন সূর্যের”
কেন যেন এই লাইন ক 'টি পড়ে তাহযিবের চোখের কোণে পানি চলে আসে।
টপটপ করে অশ্রুর ফোঁটা পড়ে যায় মোবাইলের স্ক্রীণে। নিজের মনের ভেতর কি চলেছে বুঝতে পারছেনা সে। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে তার নিজেকে।
এরপর.....।
এরপর সময় ছিল দু'জনের কাছে আসার।
কি বর্ষা বা ঝড়, ফারায ঠিক মাঝরাত্রীতেই দাঁড়িয়ে থাকতো তাহযিবকে শুধু এক পলক দেখবার। একটু দেখেই চলে যেতো হেঁটে একাকী সে রাস্তায়। তার হাঁটাতেও যেন ছিল অদ্ভুত এক মায়া। নয়তো কি আর তাহযিব বারান্দা থেকে চেয়ে থাকতো সেই বাউন্ডুলে ছেলেটির চলে যাবার দিকে। কুয়াশার ভেজা ভোরে যখন প্রকৃতি থাকতো ঘুমিয়ে, ঠিক তখনও ফারায দাঁড়িয়ে রইত দূর এক কোণে। তাহযিবকে বারান্দায় দেখেই একা হেসে মনের আনন্দে চলে আসতো।
এভাবেই ছিল সময়, সব ছিল।
মাঝে মাঝে আমি যখন মাঝরাতে দাঁড়াই বারান্দায়, দেখতে পাই ফারাযকে।
চুপিচুপি বাড়ি হতে পালিয়ে রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তার প্রিয় মানুষকে এক পলক দেখবার জন্য। কত দুরন্ত যে ছিল! একটু পর সব মিলিয়ে যায়।
মাঝে মাঝে এক রাস্তার পাশে দাঁড়ালে দেখতে পাই তাদের দু'জনকে।
তাহযিব বারান্দায় দাঁড়িয়ে, ফারায রাস্তায় চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যেন চোখের ইশারায় কথা বলে যায়। হাত নেড়ে হেঁটে চলে যায় ফারায অন্ধকারের মাঝে। আস্তে করে চোখের সামনে হতে তাহযিবও মিলিয়ে যায়, মিলিয়ে যায় ফারায। শূন্য বারান্দায় তখন কেউ থাকেনা, শূন্য পথে কেউ হেঁটে আর যায় না বাউন্ডুলেপনায়।
সব ভেসে উঠে দু'নয়নে। ভাল লাগে দৃশ্যগুলো কল্পনা করতে।
অনেক অনেক ভাল লাগে.................
লিখেছেন- Daif MD Samrat
No comments:
Post a Comment