Responsive Ads Here

20 January 2012

*কাঁঠালচাঁপা*

মিতির বয়স যখন পাঁচ বছর তখন মিতির দাদা গাছটি লাগিয়েছিলেন মিতির জন্য। কাঁঠালচাঁপা গাছ। সেই থেকে গাছটির সাথে মিতির বন্ধুতা। মিতি গাছটিতে পানি দিত প্রতিদিন, অনেক যত্ন নিত। গাছটিও অনেক ভালবাসত মিতিকে। মিতির জন্য অনেক গন্ধ বিলাত। ওদের মধ্যে এত চমৎকার বন্ধুত্ব ছিল যে মিতি গাছটির সাথে কথা বলত। গাছটিও অনেক গল্প করত প্রতিদিন। গাছটির কথাও মিতি বুঝত। বছর খানেক আগে মিতির বাবা একবার গাছটি কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন। তখন গাছ কাটার প্রতিবাদে মিতি নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। মিতির অবস্থা দেখে পরে মিতির বাবা গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন।
মিতির ঘরের জানালার পাশেই ছিল কাঁঠালচাঁপার গাছ। যেদিন রাতে ঘুম আসত না সেদিন ঘুম না আসা পর্যন্ত জানালার ধারে বসে মিতি টুকটুক করে গল্প করত কাঁঠালচাঁপার সাথে।
-“কাল রাতে ঘুমের মধ্যে চিৎকার দিয়েছিলে কেন মিতি সোনা?” কাঁঠালচাঁপা চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে মিতিকে।
-“স্বপ্নে ভূত দেখেছিলাম“ মিতি বলল।
-“ও...তাই বুঝি? জানো সোনা, কালরাতে তোমার গোঙ্গানি শুনে অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমার, ইচ্ছে হচ্ছিল তোমায় জড়িয়ে ধরি।”
-“তাই? আমার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর তোমার কথা মনে হয়েছে... তুমি তো আছই, তাইলে ভয় কিসের? সত্যি সত্যি ভূত আসলে তো তুমি ঠেঙ্গিয়ে ভূতের হাত পা ভেঙ্গে দেবে... তাইনা কাঁঠালচাঁপা? বলে হেসে কুটিকুটি হয় মিতি... মিতির হাসি দেখে কাঁঠালচাঁপাও খুশিতে দোলে উঠে, গন্ধ ছড়ায় মিতির জন্য। মিতি সেই গন্ধে মাতাল হয়ে যায়...।
-“তুমি না কালকে ভোরে উঠবে সোনা। ঘুমিয়ে পড় এখন।” বলল কাঁঠালচাঁপা।
-“ঘুম আসছে না তো সোনা। তোমায় ছেড়ে হোস্টেলে একা একা থাকব কিভাবে এইটা ভেবে অনেক মন খারাপ হচ্ছে। মন খারাপ হলে কার সাথে অনেক গল্প করব?” বলে মিতি।
কাঁঠালচাঁপারও মন খারাপ। মিতি অনেক বড় বিদ্বান হবে তো। তাই ভাল পড়াশোনা করার জন্য মিতি শহরে হোস্টেলে গিয়ে পড়বে। কাল সকালে চলে যাবে। কাঁঠালচাঁপা তার কষ্ট মিতিকে বুঝতে দেয়না । যদি কাঁঠালচাঁপা মন খারাপ করে তবে মিতির আরও বেশি কষ্ট হবে এই ভেবে কষ্ট চাপা দিয়ে কাঁঠালচাঁপা বলে, “মন খারাপ করো না সোনা। আমি বাতাসকে বলে দেব সে আমার গন্ধ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে শহরে... তোমার কাছে। তুমি ভাববে আমি তোমার কাছেই আছি।“

এই কথা শুনে অনেক খুশি হয় মিতি।
-“সত্যি কাঁঠালচাঁপা! তোমার গন্ধ না পেলে আমার ভাল্লাগবে না। আচ্ছা তুমিও মন খারাপ করো না। আমি মেঘ ছুঁয়ে দেব। আমার ছোঁয়া মেঘ ভেসে এসে বৃষ্টি হয়ে তোমায় ভিজিয়ে দেবে কাঁঠালচাঁপা। তোমার মনে হবে আমি তোমাকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছি।”

কাঁঠালচাঁপাও অনেক খুশি হয়।
-“ তাহলে আজ ঘুমিয়ে পড় সোনা, শেষে শরীর খারাপ করবে।”
-“বেশ তো, ঘুমুচ্ছি। ভাল থেকো কাঁঠালচাঁপা। গুড নাইট।” বলে ঘুমিয়ে পড়ে মিতি।
পরদিন শহরে যাওয়ার আগে মিতি অনেক আদর করে দিয়ে যায় কাঁঠালচাঁপাকে ।
কাঁঠালচাঁপা কান্না চেপে বলে, “ও মিতি, মিতি সোনা, আমাকে যেন ভুলে যেওনা।”

হোস্টেলে অনেক মন খারাপ হত মিতির। তবে মাঝে মাঝেই মিতির হোস্টেলের জানালা দিয়ে বাতাস এসে ছুঁয়ে দিত মিতির মুখ, এলোমেলো করে দিতে মিতির চুল। নাকে এসে লাগত কাঁঠালচাঁপার গন্ধ। সে গন্ধ পেলেই মন ভাল হয়ে যেত মিতির। মিতিও বৃষ্টি ছুঁয়ে দিত। সেই বৃষ্টির জল কাঁঠালচাঁপাকে যখন ভিজিয়ে দিত তখন কাঁঠালচাঁপা খুশিতে দোলে উঠত। ভাবত “যাক, মিতি তাইলে আমাকে ভুলেনি।“
একদিন মিতির শরীর অনেক খারাপ হল। মিতিকে হোস্টেল থেকে নিয়ে আসা হল। প্রথমে মিতিকে দেখে কাঁঠালচাঁপার অনেক ভাল লাগলেও পরে কাঁঠালচাঁপার মন অনেক খারাপ হল। মিতির অসুস্থতা কাঁঠালচাঁপাকে চিন্তিত করে তুলল।
মিতি শরীরে একটু ভাল বোধ করলেই কাঁঠালচাঁপার কাছে গিয়ে বসে থাকে, জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করে দেয়। তবে আগের মতো আর টুকটুক করে গল্প করে না কাঁঠালচাঁপার সাথে। কাঁঠালচাঁপা জিজ্ঞেস করে, “তোমার অসুখ ভাল হচ্ছে না কেন সোনা? তোমার কি হয়েছে?”
মিতি উত্তর দেয়না, চুপ করে থাকে।
আজ দুই দিন ধরে অনেক অনেক মন খারাপ কাঁঠালচাঁপার। তাই গাছের শাখা নেতিয়ে বসে থাকে কাঁঠালচাঁপা। কাঁঠালচাঁপার সাথে একটা দোয়েল পাখির অনেক সখ্যতা ছিল। দোয়েল মাঝেমাঝে এসে কাঁঠালচাঁপার ডালে নাচত, গান গাইত। সেদিন বিমর্ষ কাঁঠালচাঁপাকে দেখে দোয়েল জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে কাঁঠালচাঁপা? তোমার মন খারাপ কেন?”
কাঁঠালচাঁপা উত্তরে বলল, “আর বল না আমার মিতি সোনার অসুখ বেড়েছে তাই তাকে শহরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না।“ দোয়েল বলল, “মন খারাপ করো না কাঁঠালচাঁপা। ও নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবে।“
আরও তিনদিন পর মিতিকে বাড়িতে নিয়ে আসল সবাই, তবে মিতি আর কাঁঠালচাঁপার কাছে আসল না, কথাও বলল না। কারণ মিতি সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। মিতি কাঁঠালচাঁপার সাথে আর কখনোই কথা বলবে না, আর কখনোই ওর কোন যত্ন নিবে না।

কাঁঠালচাঁপা অনেক কান্নাকাটি করল। বলল, “ও মিতি সোনা তুমি কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? কেন??? তোমাকে ছেড়ে আমি কেমনে থাকব সোনা?” মিতি নেই। কাঁঠালচাঁপা গন্ধ বিলাবে কাকে? তাই মনের দুঃখে দুইদিনেই নেতিয়ে পড়ল কাঁঠালচাঁপা। বাতাস এসিয়ে দুলিয়ে দিয়ে যায় কাঁঠালচাঁপাকে, কিন্তু সে দোলায় কোন ছন্দ নেই। দোয়েল আসে, বৃথা সান্তনা দেয়। দোয়েলেরও কান্না পায়, বাতাসের মন খারাপ হয়। কিন্তু কাঁঠালচাঁপা আর মাথা তোলে না, ফুল ফোঁটায় না, গন্ধ বিলায় না... কাঁঠালচাঁপা কাঁদে, “মিতি... ও মিতি সোনা... আমি যাব তোমার কাছে...।”

লিখেছেন-মিতুলি চৌধুরী

No comments:

Post a Comment