Responsive Ads Here

20 January 2012

কার্জন হল অথবা নীলিমা (১ম পর্ব)

তখন ছাত্র হিসাবে নতুন ঢুকেছি ঢাকা ভার্সিটিতে। মফস্বল শহর এর ছেলে। কলেজ লেভেলটাও পরেছি আমার প্রানপ্রিয় ওই ছোট্ট শহরটায়। ঢাকায় এই মাত্র মাস ৪-৫ হল আছি। এই মেগা সিটির কালচার এখনও ভালভাবে ধরতে পারি নাই। আমার মত ছেলেদের এই কাজটা করতে অনেক সময় লেগে যায়। আমি পরতাম ফিজিক্সে। আনেক পড়ার চাপ। তবুও কোন যেন পড়তে ইচ্ছা করে না কারন মানিয়ে নিতে পারিনাই এখনও।

ক্লাস এ যাই......বসে থাকি। হা করে স্যারদের লেকচার শুনি......লেকচার শুনে আমার বাড্ডায় ভাড়া করা আমার ছোট রুমে এসে বসে থাকি হতাশ মনে। একদিন ক্লাস এ স্যার একদিন পড়াচ্ছিলেন আমি স্যার এর দিকে তাকায়ে আছি। স্যার একসময় একটা মেয়েকে ডেকে তুলে একটা প্রশ্ন করল। আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। ক্লাস করার সময়  খুব একটা কারো দিকে তাকাতাম না। নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে রাখতাম কারন ঐযে এখনও ঢাকার এই পরিবেশ এ আমি নিজেকে মানায়ে নিতে পারি নাই। আজই হঠাৎ করে মেয়েটার দিকে চোখ পড়ে গেল। তারপর আবার লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম পাছে যদি কেউ দেখে ফেলে এই ভয়ে।

মেয়েটা এক কথায় বলতে গেলে সুন্দরী। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ। মেয়েটা লম্বা হলেও মুখ টা গোলগাল। হাইট ৫’৪’’ থেকে ৫’৬’’ এর মধ্যে হবে। হালকা হলুদ রঙের একটা সালোওয়ার কামিজ পরা। কি মায়াকারা কি বাচ্চা সুলভ চেহারা! প্রথম দেখাতেই যে সব মেয়েদের প্রেমে পরে যেতে হয় এই মেয়েটা সেইসব মেয়েদের মধ্যেই পরে। মেয়েটাকে আমারও ভাল লাগল। ক্লাসে গিয়ে সব সময় আমন একটা জায়গায় বসতাম যেন মেয়েটাকে ভাল ভাবে দেখা যায়। একদিন গোলাপি একটা জামা পরে আসল মেয়েটা। ওইদিন অকে আরো সুন্দর লাগছিল। ওইদিন অনেক্ষন তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। লজ্জার বিষয় হল মেয়েটা দেখে ফেলেছিল যে আমি ওকে ওভাবে দেখছি। ক্লাস এর পরে আমাকে জিজ্ঞাসা করল “আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান?” আমি লজ্জায় পরে গেলাম। বললাম “না, আসলে আপনাকে দেখে যেন মনে হচ্ছে কোথাও দেখেছি।” মেয়েটা বলল “আপনার বাসা কোথায়?” আমি বললাম “আমার বাসা তো ঢাকায় না মাগুরা। আমি ঢাকার বাড্ডায় একটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকি।” তারপর মেয়েটা বলল “মাগুরাতে আমার কেউ থাকে না। আপনি হয়ত কোথাও ভুল করছেন।” আমি আবার বললাম “সরি, আমার ব্যাবহার এ কিছু মনে করবেন না।” মেয়েটা কিছু না বলেই চলে গেল। তারপরেও বারকয়েক মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়েছে। কিন্তু আর কথা হয়নি।

মাস গড়িয়ে চলল......সামনে দ্বিতীয় ক্লাস টেস্ট। প্রথমটায় তো ভালই করেছিলাম। ৪৫ জনের মধ্যে ৫ম। আমার আগে সব ঢাকার ছেলেপেলে। বাইরের সবার মধ্যে আমিই প্রথম. কিন্তু এইবার আমার প্রচণ্ড জ্বর বেধে গেল। জ্বর তার সাথে আবার মাঝে মাঝে রক্ত বমি। জ্বর নিয়েই পরীক্ষা দিতে গেলাম। ৪ ঘণ্টার পরীক্ষা। দুই আড়াই ঘণ্টা পরীক্ষা দেওয়ার পরেই আর কিছু মনে নাই। জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলাম। যখন চোখ খুললাম আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে। ডাক্তাররা কি যেন সব বলল ব্রেইন এ অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল না কি যেন। আরও দিন সাতেক আমাকে এইখানেই থাকতে হবে। মোস্তাফিজ স্যার একদিন এসে দেখে গেলেন। একদিন একদল ছেলে এসে বলল ‘দোস্ত আমাদের তো ভাল বিপদে ফেলায়ে দিয়েছিলি’। খুব ভাল লাগল ওইদিন। ভাবলাম একবারেই অনেক বন্ধু হয়ে গেল। হাসপাতাল ছাড়ব তার আগেরদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে চলে আসল ওই মেয়েটা। হাতে গোটা দশেক গোলাপ। আমাকে গোলাপ গুলো দিয়ে বলল ‘আপনি এমন কেন? এত জ্বর নিয়ে কেউ পরীক্ষা দিতে আসে?’ আমি কিছুই বলতে পারলাম না। শুধু মিন মিন করে বললাম ‘না, মানে, আসলে......।’ আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে মায়েটা বলল ‘আপনাকে ছাড়বে কবে?’ আমি বললাম ‘কাল সকালে।’ মেয়েটা আর কিছু না বলে উঠে চলে গেল। শুধু যাওয়ার সময় বলল ‘কালকে দেখা হবে’।

পরদিন সকালে যখন আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে তখন দেখি মেয়েটা আবার এসে হাজির। আমাকে বলল ‘চলুন।’ আমি বোকার মত বললাম ‘কোথায়?’ মেয়েটা বলল ‘আপনার বাসা তো এইখান থেকে অনেক দূরে, আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।’ মেয়েটার ভদ্রতায় আমি মুখ দিয়ে কথা বের করতে পারলাম না। মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে হেটে চললাম মেয়েটার পিছু পিছু হাসপাতাল এর করিডোর দিয়ে। বেরিয়ে দেখি একটা MITSUBISHI LANCER EX মডেলের গাড়ি দাড়া করানো। মেয়েটা দরজা খুলে দিল আর আমি বাধ্য ছেলের মত ভিতরে গিয়ে বসলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম মেয়েটার নাম নীলিমা। বাসায় যাওয়ার পরে ওকে আসতে বললাম একটু চা খেয়ে যেতে। নীলিমা হেসে বলল ‘আপনি নিজে আগে সুস্থ হোন তারপর না হয় একদিন আসব’।

২০-২৫ দিন পরে প্রথম ক্যাম্পাস এ গেলাম। সবাই ডেকে ডেকে কথা বলল ভালই লাগছিল। দেখলাম নীলিমা ওর এক বান্ধবীর সাথে গল্প করছে। ওর কাছে গেলাম বললাম ‘কেমন আছেন?’ আমাকে উলটা প্রশ্ন করল ‘আপনার কি খবর?’ আমি বললাম ‘এইতো এখন ৯৯% ফিট। চলুন না চা বা কফি খাই কোথাও বসে। আপনি তো ওইদিন আমার বাসায় আসলেন না।’ নীলিমা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল ‘চলুন যাই।’ চা খেতে খেতে অনেক কথা হল। আমার ভাই বোন, বাবা মা, ওর ভাই বোন ওর ফ্যামিলি এইসব। আস্তে আস্তে অনেক ভাব হয়ে গেল ওর আর আমার। কিন্তু সেই আপনি থেকে আর তুমিতে নামতে পারলাম না।

অনেকদিন পরের কথা, ২য় বর্ষের রেজাল্ট দিবে। ক্যাম্পাসে আসলাম রেজাল্ট শিট খুঁজছি। আমাকে নীলিমা পেছন থেকে ডেকে বলল ‘এই অনিক, তুমি না ফাস্টক্লাস ফাস্ট হয়েছ। এই যাহ তুমি করে বলে ফেললাম। ব্যাপার না আমরা তো এক ক্লাস এ পড়ি। তাই না?’ আমি ভাবলাম ও হয়ত মজা করছে। পরীক্ষা তো এত ভাল হয়নি। ও যখন শিট দেখাল তখনই আমার চোখ ছানাবড়া। আরও ঘণ্টা খানেক থাকতেই হইহই রব পরে গেল। ১৫-২০ টা বন্ধু ক্যাঁক করে ধরে বলল দোস্ত পার্টি চাই। আমি পরলাম মহা বিপদে। আমার এমনিতেই নিজের খরচ চালাতেই হিমশিম খাই, আবার পার্টি! তাও কষ্ট করে ওদের নিয়ে গেলাম KFC তে। আমার পকেট থেকে ছয় হাজার টাকা এক পলকেই উড়ে গেল।

সন্ধায় বাসায় ফিরে বিছানায় পিঠ ঠেকান মাত্রই ঘুমে তলিয়ে পরলাম। রাত ১ টার দিকে ঘুম ভাঙল। মোবাইল জালিয়ে সময় টা দেখলাম। কারেন্ট নেই বাইরে অনেক বাতাস হচ্ছে তাই ছাদ এ উঠে পরলাম। কিছুক্ষন ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগালাম। হঠাৎ একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নীলিমার গলা শুনতে পেলাম। আমি সম্মোহিতের মত ওর সাথে কথা চালিয়ে গেলাম। আমি ভাবতেও পারিনাই ও আমাকে ফোন দিবে। মুলত ফোন দিয়েছিল স্যরি বলতে সবার পক্ষ থেকে। আমার পকেট থেকে এত খরচ করাল সবাই মিলে তাই। আমি আবার বললাম ‘বন্ধু বান্ধব থাকলে তো এসব একটু আধটু হবেই। আমি যে এতোগুলো ভাল বন্ধু পেয়েছি ওই ঘটনার পর থেকে তাতেই আমি খুশি।’ সারারাত আমার আর ঘুম হল না। সারাখন ভাবলাম ওর সাথে কথা বলায় কোথাও ভুল করিনি তো? আরও কি কিছু বলতে হত নাকি কিছু বেশি বলে ফেললাম?

পরদিন আবার সেই ক্যাম্পাস সেই বন্ধুরা সেই ক্লাস। কিন্তু সব কিছু উপেক্ষা করে আমার মনের মধ্যে শুধু অই গত রাতের ভাবনা। নীলিমা কে ক্লাস এ দেখালাম না। নীলিমার সবচাইতে কাছের বান্ধবী বাধন কে জিজ্ঞাসা করলাম নীলিমার কি হয়েছে। ও জানালো যে ও কিছু জানে না। সকালে ফোন দিয়েছিল কিন্তু ও নাকি ফোন রিসিভ করেনাই। বিকালের দিকে আমার ২ টা ছাত্রকে পড়িয়ে বাসায় চলে আসলাম। মন মোটামুটি খারাপ। আজ সারাদিন অনেক মিস করেছি ওকে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে এলো। নীলিমাকে ফোন করব ভাবলাম। মোবাইল স্ক্রীনে ওর নাম্বার তুলে চুপচাপ বসে থাকলাম। ফোন করার আর সাহস হলো না। রাতের খাবার টেবিল এ ঢাকা দেওয়া পরে আসে খেতে ইচ্ছা করচে না। অনেক রাত হয়েগেল তাও ১ টার মত বাজে। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। ফোন দিলাম নীলিমা কে। দেখলাম ফোন খোলাই আসে। অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পরে ও ফোন তুলল। ওর নাকি জ্বর তাই ক্লাসে আসতে পারেনাই। অনেকক্ষণ কথা বললাম ওর সাথে। অনেক মিষ্টি গলা মেয়েটার যত কথা বলি আর বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করে। তারপরেও নিজেকে সামলায়ে রাখি নিজের ইচ্ছার কাছ থেকে।

এভাবেই চলতে থাকল আমার জীবন। একসময় আমার কেউ ছিল না। রাস্তায় একা একা ঘুরে এসে নিজের ভাড়া করা রুমটায় চুপ করে বসে থাকতাম। সারাদিন নিজের কথাগুলো নিজের কথা গুলো নিজের মনের মধ্যে ভেবে চলতাম। এখন আর তেমনটি হয় না। প্রায় প্রতিদিনই কথা হয় ওর সাথে, শেয়ার করি সারাদিন কি কি করলাম। একদিন আমার এক ছাত্র আমাকে ওর নিজের গার্লফ্রেন্ড এর গল্প বলল। কিভাবে মিল হলে কিভাবে ও প্রপোজ করল সব বলল। আমিও শুনলাম। মাঝে মাঝে ওদের সাথে একটু মজা করতে হয় নাহলে স্যার আর ছাত্রের সম্পর্ক ভাল থাকে না। ওই কথা নীলিমা কে ফোনে বলতেই সে কি হাসি ওর। আমাকে বলল দেখেছ এইটুকই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কত কিছু জানে। আমাদের বয়সে তো আমরা এইসব জানতামই না। এইভাবেই চলতে থাকল আমাদের কেয়ার শেয়ার।


ওর সাথে কথা না বললে যেন আমার দিন তাই কাটত না। আস্তে আস্তে আমার জীবনের একটা অংশে পরিণত হল নীলিমা নামের মেয়েটি। আসতে আসতে কেমন যেন মনে হতে থাকল। কোন কিছুই ভাল লাগত না ওকে ছাড়া। ভালবাসতে শুরু করলে কি মানুষের এমন হয়? আমি কি ভালবাসতে শুরু করেছি নীলিমা কে? কেমন যেন একটা মায়াজালে জড়িয়ে পরলাম আমি। তারপরেও আমাকে চুপ করে থাকতে হতো। কেন চুপ আছি আমি? আমি যে একটা হারিকেনের কাঁচ। সেই কাঁচের বাইরে হালকা নরম আলো আর ভিতরে একটা কেরোসিনের সলতে জ্বলেপুড়ে মরছে। মধ্যবিত্ত হওয়ারটা যে কত কষ্টের তা আমি এতদিন পরে টের পেলাম। আমি কখনও এই নিয়ে ভাবিনি কিন্তু আজ আমাকে ভাবতে হচ্ছে। আমি এখন কি করব? আমি কি পারব এই মায়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে নাকি আটকা পরে যাব? এইসব ভাবতে ভাবতে রাত পেরিয়ে যায়। ঘুমহীন চোখে ক্যাম্পাস এ যাই। এভাবেই চলতে থাকে আমার দিনলিপি। অনেক ভাবনা চিন্তা করার পর সিদ্ধান্ত নিলাম আমি নীলিমা কে কিছুই বলব না আমার পক্ষ থেকে। আমার কথা বলে আমি ওকে কষ্ট দিতে চাই না।

লিখেছেন- মির্জা মুহাম্মাদ তামজীদ (জিত)

সংগ্রহে - লিমন

No comments:

Post a Comment