তখন ৩য় বর্ষের ক্লাস শেষ। আমি নীলিমাকে বলে ক্যাম্পাসে এসেছি। শুনলাম ও আসবে নাকি? প্রথমে আমাকে বলল আসবে না। পরে আবার দেখলাম আমাকে ফোন দিয়েছে। আমি তখন স্যার এর সাথে একটু কাজে ব্যস্ত। আমি ওকে আমাদের আড্ডাস্থল শিমুল গাছটার নীচে বসে অপেক্ষা করতে বললাম। কাজ শেষ করে গিয়ে দেখি ও একা একা বসে আছে। আমি পাশে গিয়ে বসলাম। আমাকে ওমনি একটা বকা দিয়ে বলল ‘এই ছেলে নোংরার মধ্যে বসলে জায়গাটা একটু ঝেড়ে নিতে হয় তুমি তাও জান না?’ আমি আবার উঠলাম ঝেড়ে নিয়ে আবার বসলাম। শান বাধানো শিমুল গাছের ওই জায়গা টা আমাদের বন্ধুদের সবারই খুব পছন্দের। ফিজিক্স এর ছেলেমেয়ে দের একতরফা শাসন চলে ওই গাছটার নীচে। চা খেলাম দুইজন। গল্প করতে থাকলাম টুকটুক করে। একসময় ভাবলাম নাহ, আমি আর পারব না। আজকেই বলে দিব আমার সব কথা নীলিমা কে। বেশ কিছুক্ষন মানে তাও মিনিট ২-৩, হঠাৎ করেই দুইজন একসাথে বলে ফেললাম ‘তোমাকে একটা কথা বলব।’ মানে নীলিমা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল আর আমিও ওকে উদ্দেশ্য করে বললাম। হেসে ফেললাম দুইজনই। আমি ওকে আগে বলার সু্যোগ দিলাম। ও বলল ‘না তুমি বল’। এভাবে চলল বার কয়েক। শেষমেষ নীলিমা আমার কাছে হেরে গেল। ওকেই বলতে হলো প্রথমে। কেমন যেন একটু নার্ভাস দেখলাম আমি ওকে। কিছুক্ষণ থেমে আমাকে বলল ‘অনিক, তুমি আমাকে তোমার অন্যসব মেয়ে ফ্রেন্ডদের থেকে একটু আলাদা চোখে দেখা শুরু করেছ, তাই না?’ আমি কি বলব ভাষা খুজে পেলাম না। আমি এক বুক সাহস নিয়ে বললাম ‘দেখা শুরু করেছি না। আমি প্রথম দিন থেকেই তোমাকে একটু আলাদা চোখে দেখতাম।’ তারপর আরও মিনিট ৯-১০ আমরা চুপচাপ বসলাম। নিরবতা ভেঙ্গে নীলিমা আমাকে বলল ‘আমি আজ যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ এই বলে ও উঠে চলে গেল।
কি হবে? ও কিছু মনে করল নাকি? এইসব ভাবতে ভাবতে বাসায় আসলাম। দুপুরের ভাত না খেয়েই ঘুমিয়ে পরলাম নিজের অজান্তেই। সন্ধ্যার দিকে ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে সময় দেখতে গিয়ে দেখি নীলিমার মেসেজ। মেসেজটায় লেখা আছে ‘ছেলে মানুষ যে এত ভিতু হয় জানতাম না। ৩ বছর ধরে পেটে কথা রেখে দিয়েছিলে? এই রকম ভিতু ছেলের সাথেই যে আমার এখন ভাব করতে ইচ্ছা করছে এখন। কি করব বলত? কালকে সকালে ক্যাম্পাস এ চলে আসবে। বুঝেছ ভিতুর ডিম?’ আমি কি করব বুঝতে পারলাম না। শুধু দৌড় দিয়ে ছাদে উঠে গিয়ে চিৎকার করে বলতে চাইলাম ‘নীলিমা আমি তোমাকে ভালবাসি।’ ছাদে উঠেও গেলাম। কিন্তু চিৎকার করে বলতে পারলাম না কথা টা। কারন আমি ভিতু, যদি কেউ শুনে ফেলে এই লজ্জায়।
পরদিন সেই আগের জায়গায় গিয়ে দেখি নীলিমা বসে আছে। আমিও পাশে গিয়ে বসলাম। আগেও অনেকবার বসেছি ওর পাশে। কিন্তু এমন অনুভুতি আগে হয়নি। তখন যে ও আমাকে ভিতুর ডিম বলে লজ্জা দেয়নি। আজকে আসলেই অন্যরকম ভাল লাগছে। কিছু বলতে পারছি না। দুইজনই চুপ করে বসে আছি। নীলিমাই প্রথমে বলল ‘আমি একটা ভিতু ছেলের জন্য একটা গিফট এনেছি। সে কি কথা বলবে নাকি চুপ করে বসে থাকবে?’ আমি আমার নীরবতা ভেঙ্গে বললাম ‘ভিতু ছেলেটাও তোমার জন্য একটা গিফট এনেছে।’ নীলিমা ওর গিফট একটা সুন্দর কার্ড আমাকে দিল কাগজে মোড়ানো। আমিও একটা কার্ড দিলাম ওইটাও কাগজে মোড়ানো। দুইজনই ওয়াদা করলাম যার যার বাসায় গিয়ে গিফট খোলা হবে। বাসায় এসে খুলে দেখি অনেক সুন্দর একটা লাভ কার্ড দিয়েছে ও আমাকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমিও ওকে একই কার্ড দিয়েছি। একদম হুবহু এক। কোথাও কোন আমিল নাই। বাসায় গিয়ে কার্ড দেখে ও আমাকে ফোন দিল। আমি রিসিভ করেই হেসে ফেললাম। ও নিজেও হেসে ফেলল…………..
চলতে থাকল আমাদের ভালবাসা ভালবাসা নামের খেলাটি। আমরা আমাদের শিমুল গাছের পাদদেশের সেই বসার জায়গা বদলিয়ে ফেললাম। এখন এসে বসি কার্জন হলের সামনের খোলা জায়গাটায়। টুকটুক করে গল্প করি দুইজন। দুপুরে ক্লাস শেষ করে ল্যাব ক্লাস শেষ হতে হতে বিকাল। আর আমাদের গল্প শেষ হতে হতে সন্ধ্যা। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব, খুব সুখী মনে হতো। চলে যাওয়ার সময় যখন আমার গালে হাত রেখে নীলিমা বলত ‘আসি, কেমন?’ আমার খুব ইচ্ছা হতো ওকে জড়িয়ে ধরে বলি ‘না, তুমি যাবে না। আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিব না।’ বলতে পারতাম না আমার কথা গুলো। খুব কষ্ট পেতাম তখন আমি।
খুব ভাল বোঝাপড়া ছিল আমাদের মধ্যে। Understanding যেটাকে বলে। আমার আমাদের সব কথা শেয়ার করতাম দুইজন দুইজনকে। আমাদের মধ্যে গোপন কিছু ছিল না। ও আমাকে সব কিছু বলত। সময়ের ব্যবধানে ফাইনাল পরীক্ষা চলে এলো। সবাই প্রচণ্ড চাপের মুখে পুরোদমে লেখাপড়া শুরু করেছি। দুইজন আর দুইজন কে আগের মত সময় দিতে পারি না। আমিও ওকে তেমন একটা ডাকতাম না দেখা করার জন্য লেখাপড়ার ক্ষতি হবে এই ভাবে। ৩-৪ দিন পরপর দেখা হয়। ঘণ্টা খানেক কথা হয় বসে থাকি পাশাপাশি। আসতে আসতে ৫-৬ দিন হলো। তারপর ৮-৯ দিন হলো। তারপর হঠাৎ করে পরীক্ষা চলে আসল। পরীক্ষার আগে দেখাকরে আসলাম ওর সাথে। দুজনই দোয়া নিলাম দুজনের কাছ থেকে। শুরু হয়ে গেল পরীক্ষা…………
৫৩ দিন ধরে চলল পরীক্ষা। নীলিমা নিজেও দেখা করতে চায়নি, তাই আমিও ওকে ডেকে ওর সময় নষ্ট করিনি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে বাবা মা বাসায় যেতে বলল। যেতেই তো হবে সামনে দীর্ঘ ছুটি। কিন্তু আমি নীলিমাকে ছেড়ে এতদিন থাকব কিভাবে। এতদিন না হয় ওর পরীক্ষা ছিল তাই দেখা করতে পারেনাই। কিন্তু এখন তো ছুটি থাকবে। আমাকে খুব মিস করবে মেয়েটা। আমিও করব ভীষণ ভাবে। ওকে বললাম ‘বাসায় যাব’ বাবা মা যেতে বলেছে। মন খারাপ করে ফেলল ও। তারপরই আবার বলল খুশি মনে ‘যাও, কিছুদিন থেকে আস। অনেকদিন তো যাও না। বাবা-মা কে তো একটু সময় দিবে নাকি?’ আমি বললাম, ‘তোমাকে অনেক মিস করব। ছুটির মধ্যে কি করবে তুমি?’ ও হেসে বলল ‘তুমি যাবে তোমার নিজের বাসায় আর আমি যাব আমার মামার বাসায়। সিলেটে থাকেন মামা।’ আমি বললাম ‘যত তারাতারি পারি আমি চলে আসব।’ নীলিমাও বলল ‘আমিও’।
পরদিন চলে আসলাম আমার নিজের শহর মাগুরায়। পুরাতন সব বন্ধু, পুরাতন সব রাস্তাঘাট দেখে মন ভাল হয়ে গেল। তবুও মনে পরে থাকল সেই কার্জন হলের সামনে বসে থাকা বিকাল বা সন্ধ্যা গুলতে............ ফোন কথা হতো এস এম এস দেওয়া নেওয়া হত দুজনের মধ্যে। কিন্তু এইসব তো আর নীলিমা কে কাছে পাওয়ার মত আনন্দের না।
দুই মাসের মাথায় হুট করে রেজাল্ট দিয়ে দিল। ঢাকায় চলে আসলাম। নীলিমা জানাল যে ও এখনও আসে নাই। আসতে আরও দিন দশেক লাগবে। নীলিমার তো এমন করার কথা না। ও তো আরও আগে চলে আসতে চেয়েছিল। ৭ দিনের মাথায় মোস্তাফিজ স্যার ডেকে পাঠালেন। আমি স্যার এর কাছে গেলাম, গিয়ে জানতে পারলাম। আমি নাকি একটা স্কলারশিপ পেয়েছি, হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি চিঠি টা নিয়ে চলে আসলাম লাফাতে লাফাতে। প্রথমেই ফোন করলাম নীলিমাকে। শুভেচ্ছা জানালো আমাকে। তারপর একে একে মা-বাবা কে জানালাম। সবাই শুনে খুব খুশী হল। মন কিছুতেই মানছিলনা। কমলাপুর গিয়ে সিলেট এর টিকেট কিনে ফেললাম। নীলিমা কে জানালাম যে আমি আসছি। নীলিমা আমাকে জানালো যে আমার যাওয়ার দরকার নাই। ও নিজেই পরশু চলে আসছে। একা একাই লাফাচ্ছি। এত নামিদামি জায়গায় স্কলারশিপ পাওয়া তো আর সোজা কথা না। কিন্তু একটা কথা ভেবে কষ্টও হচ্ছে, নীলিমা এইখানে থাকবে আর আমি চলে যাব?
২ দিন পর ও আসল। আমি আর ও দেখা করলাম কার্জন হলের সেই পুরানো জায়গাটিতে। অনেকদিনের ব্যবধানে দেখছি ওকে। অনেক রোগা হয়ে গেছে ও। গায়ের রঙটাও আর আগের মত নেই। কালো হয়েছে একটু। আমার পাশে এসে চুপকরে বসল। আমাকে কিছু না বলে নীলিমা ওর মোবাইলটা আমার হাতে দিয়ে বলল দেখ। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না ওর কথা। আমি বললাম ‘কি দেখব?’ নীলিমা কিছু বলল না। আমি ওর ইনবক্সটা ওপেন করলাম। অচেনা একটা নাম্বার থেকে আসা মেসেজ দিয়ে ইনবক্সটা ভর্তি। আমি একটাও ওপেন করলাম না। শুধু ওকে বললাম ‘নাম্বার টা কার?’ নীলিমা কিছুই বলল না। আমি আবার ওকে জিজ্ঞাসা করলাম। তারপর ও আস্তে করে বলল ‘অনিক, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমার কিছুই করার ছিল না, বিশ্বাস কর অনিক। পুরো বিষয়টা খুলে বললেই তুমি বুঝবে।’ আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার শুধু মনে হচ্ছে আমাকে এই পৃথিবী থেকে কেউ তুলে নিচ্ছে আর আমি যে কিছু ধরে নিজের আশ্রয় খুজব সেইরকম কোন খড় কুটোও পাচ্ছি না। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা কথা বেরচ্ছিল না। আমি শুধু বললাম ‘আমি আর কিছু শুনতে চাই না।’ এই প্রথম আমি ওকে রেখে একা একা চলে এলাম। একটি বার পেছনে ফিরে তাকাতে খুব ইচ্ছা করল তাও নিজেকে ধরে রাখলাম।
কোনমতে বাসায় ফিরলাম। নিজের চোখের পানিকে আর চেপে রাখতে পারলাম না। আঝরে কেদে ফেললাম। আমার এতদিনের ভালবাসা মাত্র কয়েক সেকেন্ড এ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল? কি দোষ করেছিলাম আমি? আমি কি এতই খারাপ। আমার এতদিনের ভালবাসা পারল ও ভুলে যেতে? কিভাবে সম্ভব করল ও এটা? রিং বেজে উঠল ফোন। দেখলাম নীলিমা ফোন দিয়েছে। ইচ্ছা করেই ধরলাম না। এখন তো ও আমার কেউ হয় না। এখন ও অন্য একজনের সম্পদ। আমার আর কোন অধিকার নেই ওর উপর।
পরেরদিনই মোস্তাফিজ স্যারের কাছে গিয়ে বললাম ‘স্যার, আমাকে খুব তাড়াতাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। আমাকে যা যা করতে হয় বলুন।’ স্যারের কথামতো কাজ করে ৩ দিনের মধ্যে সব কাগজ পত্র রেডি করে ফেললাম। বাবা-মা আমাকে তাদের প্রায় সব সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে আমার টাকা যোগার করে দিলেন। আমি ২৭ দিনের মাথায় হামবুর্গ চলে গেলাম। দেশে ফেলে রেখে গেলাম আমার নীলিমা কে আর কার্জন হলের কিছু দিন……………………
১০ বছর পর আজ আমি দেশে। বসে আছি বারিধারয় আমার নিজের কেনা বাড়ির লনে। এইত দিন পাঁচেক হল এসেছি। আবার চলে যাব দিন ২০-২৫ পরেই। আমি এখন আর হামবুর্গ থাকি না। ক্যালটেকে কাজ করছি বিজ্ঞানী হিসাবে। বাবা-মাও আর মাগুরায় থাকেন না। আমার বাড়িতেই রেখে দিয়েছি। দেখাশোনার জন্য অনেক লোক আছে। থাকেন তারা সুখে শান্তিতেই। গতদিন আবরার এসেছিল। এক সাথেই পরতাম। ও জয়েন করেছে ওর নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই। ভালই আছে সবাই। আমাকে জিজ্ঞাসা করল নীলিমার বিষয়ে। আমি বললাম ‘খবর রাখিনাই। ও নিজেও ওইদিনের পর আর যোগাযোগ করেনাই’।
সকালে ফোন দিয়েছিল ও। নিজেই খবর টা জেনে আমাকে জানালও নীলিমা নাকি ভাল নেই। বিয়ে হয়েছিল ওই ছেলের সাথেই। পরে আর ওরা চালিয়ে যেতে পারে নাই। ছাড়াছাড়ি হয়েছে বছর দুয়েকের মধ্যেই। এখন নাকি নিজের বাবার বাসাতেই থাকে। আমার কথা নাকি শুনতে চেয়েছে ওদের কাছে। ওরাও কিছু বলতে পেরেছিল না তখন আমার বিষয়ে। মাঝে মাঝেই নাকি ক্যাম্পাসে যায়। একা একাই বসে থাকে। শুনে খুব খারাপই লাগল।
আজকেই তো সেই দিন যেদিন আমি ওকে রেখে চলে আসলাম। আজও মনে পরে বাসায় ফিরে অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন। আজ আর কান্না পাচ্ছে না। একবার ভাবলাম যাই। ঘুরে আসি আমার সেই কার্জন হল থেকে। আবার ভাবলাম, থাক পুরানো কথা আর মনে করে লাভ নাই। দুপুর গড়িয়ে গেল। দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকালাম। মনে পরে গেল আমার সেই ১০-১২ বছর আগের সেই ছোট্ট রুমটার কথা। বিকালে গাড়ি নিয়ে বেরবো ভাবলাম। গাড়ির চাবি টা নিতে গিয়েই চোখ পরল আমার ড্রয়ার এর মধ্যে। চোখ পরল নীলিমার দেওয়া গিফট গুলোর দিকে। খুব মনে পড়ল ওকে। মনের কাছে হার মেনে গাড়ি টা নিয়ে বের হলাম কার্জন হলের উদ্দেশ্য।
১০ বছর পরের কার্জন হল দেখে একটু নতুন ই লাগল। তখন কেবল সন্ধ্যা গড়িয়েছে। গাড়িটা পার্ক করে হেটে চললাম। আর মাত্র কিছুক্ষন হাঁটলেই আমার সেই পুরনো দিন গুলোতে ফিরে যাব। কিন্তু একজন থাকবে না। আর সে হল আমার নীলিমা। কিন্তু একি? সেই পাতাবাহার গাছটার নীচে যে একটা মেয়ে বসে আছে। আমি কি আজ তাহলে আর বসতে পারব না আমার সেই প্রিয় জায়গা টায়? চলে যাব ফিরে? আমি আরও কিছুক্ষণ এগিয়ে গেলাম যদি মেয়েটা আমাকে দেখে চলে যায়।
আমি আরও কিছুক্ষণ এগিয়ে যাওয়ার পরে আর চলতে পারলাম না। আমার পা আটকে গেল মাটির সাথে। আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ওইটা যে নীলিমা। আমাকে দেখতে পায়নি এখনও। আমি কি করব? যাব ওর সামনে নাকি ফিরে চলে যাব? আমি আবার হেরে গেলাম নিজের কাছে। আজ যে পিছু যেতে নেই। আজ যে সব কিছু ভুলে যাওয়ার পালা। আজ কিছু মনে রাখতে নেই। আজ যে আমি আবার এসেছি আমার পুরনো দিনে ফিরে যেতে। আমি এগিয়ে চলছি লেখা হতে যাচ্ছে আরও একটা নতুন জীবনের মহাসঙ্গীত…………………..
(গল্পটি দুই পর্বে প্রকাশিত হল)
লিখেছেন- মির্জা মুহাম্মাদ তামজীদ (জিত)
সংগ্রহে - লিমন
কি হবে? ও কিছু মনে করল নাকি? এইসব ভাবতে ভাবতে বাসায় আসলাম। দুপুরের ভাত না খেয়েই ঘুমিয়ে পরলাম নিজের অজান্তেই। সন্ধ্যার দিকে ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে সময় দেখতে গিয়ে দেখি নীলিমার মেসেজ। মেসেজটায় লেখা আছে ‘ছেলে মানুষ যে এত ভিতু হয় জানতাম না। ৩ বছর ধরে পেটে কথা রেখে দিয়েছিলে? এই রকম ভিতু ছেলের সাথেই যে আমার এখন ভাব করতে ইচ্ছা করছে এখন। কি করব বলত? কালকে সকালে ক্যাম্পাস এ চলে আসবে। বুঝেছ ভিতুর ডিম?’ আমি কি করব বুঝতে পারলাম না। শুধু দৌড় দিয়ে ছাদে উঠে গিয়ে চিৎকার করে বলতে চাইলাম ‘নীলিমা আমি তোমাকে ভালবাসি।’ ছাদে উঠেও গেলাম। কিন্তু চিৎকার করে বলতে পারলাম না কথা টা। কারন আমি ভিতু, যদি কেউ শুনে ফেলে এই লজ্জায়।
পরদিন সেই আগের জায়গায় গিয়ে দেখি নীলিমা বসে আছে। আমিও পাশে গিয়ে বসলাম। আগেও অনেকবার বসেছি ওর পাশে। কিন্তু এমন অনুভুতি আগে হয়নি। তখন যে ও আমাকে ভিতুর ডিম বলে লজ্জা দেয়নি। আজকে আসলেই অন্যরকম ভাল লাগছে। কিছু বলতে পারছি না। দুইজনই চুপ করে বসে আছি। নীলিমাই প্রথমে বলল ‘আমি একটা ভিতু ছেলের জন্য একটা গিফট এনেছি। সে কি কথা বলবে নাকি চুপ করে বসে থাকবে?’ আমি আমার নীরবতা ভেঙ্গে বললাম ‘ভিতু ছেলেটাও তোমার জন্য একটা গিফট এনেছে।’ নীলিমা ওর গিফট একটা সুন্দর কার্ড আমাকে দিল কাগজে মোড়ানো। আমিও একটা কার্ড দিলাম ওইটাও কাগজে মোড়ানো। দুইজনই ওয়াদা করলাম যার যার বাসায় গিয়ে গিফট খোলা হবে। বাসায় এসে খুলে দেখি অনেক সুন্দর একটা লাভ কার্ড দিয়েছে ও আমাকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমিও ওকে একই কার্ড দিয়েছি। একদম হুবহু এক। কোথাও কোন আমিল নাই। বাসায় গিয়ে কার্ড দেখে ও আমাকে ফোন দিল। আমি রিসিভ করেই হেসে ফেললাম। ও নিজেও হেসে ফেলল…………..
চলতে থাকল আমাদের ভালবাসা ভালবাসা নামের খেলাটি। আমরা আমাদের শিমুল গাছের পাদদেশের সেই বসার জায়গা বদলিয়ে ফেললাম। এখন এসে বসি কার্জন হলের সামনের খোলা জায়গাটায়। টুকটুক করে গল্প করি দুইজন। দুপুরে ক্লাস শেষ করে ল্যাব ক্লাস শেষ হতে হতে বিকাল। আর আমাদের গল্প শেষ হতে হতে সন্ধ্যা। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব, খুব সুখী মনে হতো। চলে যাওয়ার সময় যখন আমার গালে হাত রেখে নীলিমা বলত ‘আসি, কেমন?’ আমার খুব ইচ্ছা হতো ওকে জড়িয়ে ধরে বলি ‘না, তুমি যাবে না। আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিব না।’ বলতে পারতাম না আমার কথা গুলো। খুব কষ্ট পেতাম তখন আমি।
খুব ভাল বোঝাপড়া ছিল আমাদের মধ্যে। Understanding যেটাকে বলে। আমার আমাদের সব কথা শেয়ার করতাম দুইজন দুইজনকে। আমাদের মধ্যে গোপন কিছু ছিল না। ও আমাকে সব কিছু বলত। সময়ের ব্যবধানে ফাইনাল পরীক্ষা চলে এলো। সবাই প্রচণ্ড চাপের মুখে পুরোদমে লেখাপড়া শুরু করেছি। দুইজন আর দুইজন কে আগের মত সময় দিতে পারি না। আমিও ওকে তেমন একটা ডাকতাম না দেখা করার জন্য লেখাপড়ার ক্ষতি হবে এই ভাবে। ৩-৪ দিন পরপর দেখা হয়। ঘণ্টা খানেক কথা হয় বসে থাকি পাশাপাশি। আসতে আসতে ৫-৬ দিন হলো। তারপর ৮-৯ দিন হলো। তারপর হঠাৎ করে পরীক্ষা চলে আসল। পরীক্ষার আগে দেখাকরে আসলাম ওর সাথে। দুজনই দোয়া নিলাম দুজনের কাছ থেকে। শুরু হয়ে গেল পরীক্ষা…………
৫৩ দিন ধরে চলল পরীক্ষা। নীলিমা নিজেও দেখা করতে চায়নি, তাই আমিও ওকে ডেকে ওর সময় নষ্ট করিনি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে বাবা মা বাসায় যেতে বলল। যেতেই তো হবে সামনে দীর্ঘ ছুটি। কিন্তু আমি নীলিমাকে ছেড়ে এতদিন থাকব কিভাবে। এতদিন না হয় ওর পরীক্ষা ছিল তাই দেখা করতে পারেনাই। কিন্তু এখন তো ছুটি থাকবে। আমাকে খুব মিস করবে মেয়েটা। আমিও করব ভীষণ ভাবে। ওকে বললাম ‘বাসায় যাব’ বাবা মা যেতে বলেছে। মন খারাপ করে ফেলল ও। তারপরই আবার বলল খুশি মনে ‘যাও, কিছুদিন থেকে আস। অনেকদিন তো যাও না। বাবা-মা কে তো একটু সময় দিবে নাকি?’ আমি বললাম, ‘তোমাকে অনেক মিস করব। ছুটির মধ্যে কি করবে তুমি?’ ও হেসে বলল ‘তুমি যাবে তোমার নিজের বাসায় আর আমি যাব আমার মামার বাসায়। সিলেটে থাকেন মামা।’ আমি বললাম ‘যত তারাতারি পারি আমি চলে আসব।’ নীলিমাও বলল ‘আমিও’।
পরদিন চলে আসলাম আমার নিজের শহর মাগুরায়। পুরাতন সব বন্ধু, পুরাতন সব রাস্তাঘাট দেখে মন ভাল হয়ে গেল। তবুও মনে পরে থাকল সেই কার্জন হলের সামনে বসে থাকা বিকাল বা সন্ধ্যা গুলতে............ ফোন কথা হতো এস এম এস দেওয়া নেওয়া হত দুজনের মধ্যে। কিন্তু এইসব তো আর নীলিমা কে কাছে পাওয়ার মত আনন্দের না।
দুই মাসের মাথায় হুট করে রেজাল্ট দিয়ে দিল। ঢাকায় চলে আসলাম। নীলিমা জানাল যে ও এখনও আসে নাই। আসতে আরও দিন দশেক লাগবে। নীলিমার তো এমন করার কথা না। ও তো আরও আগে চলে আসতে চেয়েছিল। ৭ দিনের মাথায় মোস্তাফিজ স্যার ডেকে পাঠালেন। আমি স্যার এর কাছে গেলাম, গিয়ে জানতে পারলাম। আমি নাকি একটা স্কলারশিপ পেয়েছি, হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি চিঠি টা নিয়ে চলে আসলাম লাফাতে লাফাতে। প্রথমেই ফোন করলাম নীলিমাকে। শুভেচ্ছা জানালো আমাকে। তারপর একে একে মা-বাবা কে জানালাম। সবাই শুনে খুব খুশী হল। মন কিছুতেই মানছিলনা। কমলাপুর গিয়ে সিলেট এর টিকেট কিনে ফেললাম। নীলিমা কে জানালাম যে আমি আসছি। নীলিমা আমাকে জানালো যে আমার যাওয়ার দরকার নাই। ও নিজেই পরশু চলে আসছে। একা একাই লাফাচ্ছি। এত নামিদামি জায়গায় স্কলারশিপ পাওয়া তো আর সোজা কথা না। কিন্তু একটা কথা ভেবে কষ্টও হচ্ছে, নীলিমা এইখানে থাকবে আর আমি চলে যাব?
২ দিন পর ও আসল। আমি আর ও দেখা করলাম কার্জন হলের সেই পুরানো জায়গাটিতে। অনেকদিনের ব্যবধানে দেখছি ওকে। অনেক রোগা হয়ে গেছে ও। গায়ের রঙটাও আর আগের মত নেই। কালো হয়েছে একটু। আমার পাশে এসে চুপকরে বসল। আমাকে কিছু না বলে নীলিমা ওর মোবাইলটা আমার হাতে দিয়ে বলল দেখ। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না ওর কথা। আমি বললাম ‘কি দেখব?’ নীলিমা কিছু বলল না। আমি ওর ইনবক্সটা ওপেন করলাম। অচেনা একটা নাম্বার থেকে আসা মেসেজ দিয়ে ইনবক্সটা ভর্তি। আমি একটাও ওপেন করলাম না। শুধু ওকে বললাম ‘নাম্বার টা কার?’ নীলিমা কিছুই বলল না। আমি আবার ওকে জিজ্ঞাসা করলাম। তারপর ও আস্তে করে বলল ‘অনিক, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমার কিছুই করার ছিল না, বিশ্বাস কর অনিক। পুরো বিষয়টা খুলে বললেই তুমি বুঝবে।’ আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার শুধু মনে হচ্ছে আমাকে এই পৃথিবী থেকে কেউ তুলে নিচ্ছে আর আমি যে কিছু ধরে নিজের আশ্রয় খুজব সেইরকম কোন খড় কুটোও পাচ্ছি না। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা কথা বেরচ্ছিল না। আমি শুধু বললাম ‘আমি আর কিছু শুনতে চাই না।’ এই প্রথম আমি ওকে রেখে একা একা চলে এলাম। একটি বার পেছনে ফিরে তাকাতে খুব ইচ্ছা করল তাও নিজেকে ধরে রাখলাম।
কোনমতে বাসায় ফিরলাম। নিজের চোখের পানিকে আর চেপে রাখতে পারলাম না। আঝরে কেদে ফেললাম। আমার এতদিনের ভালবাসা মাত্র কয়েক সেকেন্ড এ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল? কি দোষ করেছিলাম আমি? আমি কি এতই খারাপ। আমার এতদিনের ভালবাসা পারল ও ভুলে যেতে? কিভাবে সম্ভব করল ও এটা? রিং বেজে উঠল ফোন। দেখলাম নীলিমা ফোন দিয়েছে। ইচ্ছা করেই ধরলাম না। এখন তো ও আমার কেউ হয় না। এখন ও অন্য একজনের সম্পদ। আমার আর কোন অধিকার নেই ওর উপর।
পরেরদিনই মোস্তাফিজ স্যারের কাছে গিয়ে বললাম ‘স্যার, আমাকে খুব তাড়াতাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। আমাকে যা যা করতে হয় বলুন।’ স্যারের কথামতো কাজ করে ৩ দিনের মধ্যে সব কাগজ পত্র রেডি করে ফেললাম। বাবা-মা আমাকে তাদের প্রায় সব সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে আমার টাকা যোগার করে দিলেন। আমি ২৭ দিনের মাথায় হামবুর্গ চলে গেলাম। দেশে ফেলে রেখে গেলাম আমার নীলিমা কে আর কার্জন হলের কিছু দিন……………………
১০ বছর পর আজ আমি দেশে। বসে আছি বারিধারয় আমার নিজের কেনা বাড়ির লনে। এইত দিন পাঁচেক হল এসেছি। আবার চলে যাব দিন ২০-২৫ পরেই। আমি এখন আর হামবুর্গ থাকি না। ক্যালটেকে কাজ করছি বিজ্ঞানী হিসাবে। বাবা-মাও আর মাগুরায় থাকেন না। আমার বাড়িতেই রেখে দিয়েছি। দেখাশোনার জন্য অনেক লোক আছে। থাকেন তারা সুখে শান্তিতেই। গতদিন আবরার এসেছিল। এক সাথেই পরতাম। ও জয়েন করেছে ওর নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই। ভালই আছে সবাই। আমাকে জিজ্ঞাসা করল নীলিমার বিষয়ে। আমি বললাম ‘খবর রাখিনাই। ও নিজেও ওইদিনের পর আর যোগাযোগ করেনাই’।
সকালে ফোন দিয়েছিল ও। নিজেই খবর টা জেনে আমাকে জানালও নীলিমা নাকি ভাল নেই। বিয়ে হয়েছিল ওই ছেলের সাথেই। পরে আর ওরা চালিয়ে যেতে পারে নাই। ছাড়াছাড়ি হয়েছে বছর দুয়েকের মধ্যেই। এখন নাকি নিজের বাবার বাসাতেই থাকে। আমার কথা নাকি শুনতে চেয়েছে ওদের কাছে। ওরাও কিছু বলতে পেরেছিল না তখন আমার বিষয়ে। মাঝে মাঝেই নাকি ক্যাম্পাসে যায়। একা একাই বসে থাকে। শুনে খুব খারাপই লাগল।
আজকেই তো সেই দিন যেদিন আমি ওকে রেখে চলে আসলাম। আজও মনে পরে বাসায় ফিরে অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন। আজ আর কান্না পাচ্ছে না। একবার ভাবলাম যাই। ঘুরে আসি আমার সেই কার্জন হল থেকে। আবার ভাবলাম, থাক পুরানো কথা আর মনে করে লাভ নাই। দুপুর গড়িয়ে গেল। দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকালাম। মনে পরে গেল আমার সেই ১০-১২ বছর আগের সেই ছোট্ট রুমটার কথা। বিকালে গাড়ি নিয়ে বেরবো ভাবলাম। গাড়ির চাবি টা নিতে গিয়েই চোখ পরল আমার ড্রয়ার এর মধ্যে। চোখ পরল নীলিমার দেওয়া গিফট গুলোর দিকে। খুব মনে পড়ল ওকে। মনের কাছে হার মেনে গাড়ি টা নিয়ে বের হলাম কার্জন হলের উদ্দেশ্য।
১০ বছর পরের কার্জন হল দেখে একটু নতুন ই লাগল। তখন কেবল সন্ধ্যা গড়িয়েছে। গাড়িটা পার্ক করে হেটে চললাম। আর মাত্র কিছুক্ষন হাঁটলেই আমার সেই পুরনো দিন গুলোতে ফিরে যাব। কিন্তু একজন থাকবে না। আর সে হল আমার নীলিমা। কিন্তু একি? সেই পাতাবাহার গাছটার নীচে যে একটা মেয়ে বসে আছে। আমি কি আজ তাহলে আর বসতে পারব না আমার সেই প্রিয় জায়গা টায়? চলে যাব ফিরে? আমি আরও কিছুক্ষণ এগিয়ে গেলাম যদি মেয়েটা আমাকে দেখে চলে যায়।
আমি আরও কিছুক্ষণ এগিয়ে যাওয়ার পরে আর চলতে পারলাম না। আমার পা আটকে গেল মাটির সাথে। আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ওইটা যে নীলিমা। আমাকে দেখতে পায়নি এখনও। আমি কি করব? যাব ওর সামনে নাকি ফিরে চলে যাব? আমি আবার হেরে গেলাম নিজের কাছে। আজ যে পিছু যেতে নেই। আজ যে সব কিছু ভুলে যাওয়ার পালা। আজ কিছু মনে রাখতে নেই। আজ যে আমি আবার এসেছি আমার পুরনো দিনে ফিরে যেতে। আমি এগিয়ে চলছি লেখা হতে যাচ্ছে আরও একটা নতুন জীবনের মহাসঙ্গীত…………………..
(গল্পটি দুই পর্বে প্রকাশিত হল)
লিখেছেন- মির্জা মুহাম্মাদ তামজীদ (জিত)
সংগ্রহে - লিমন
No comments:
Post a Comment