বিকেল বেলা ছাদের কার্নিশে বসে বায়োলজি পড়তে খুব ভাল লাগে আমার। কয়েকদিন পরেই এস,এস,সি এর রেজাল্ট দিবে। জানি এ+ পাব, তবুও রেজাল্টের কথা মনে পড়তেই ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে ! যদি গোল্ডেন ৫ না পাই, তাহলে এলাকায় মুখ দেখাব কি করে? ঝুমুরের কাছে ছোট হয়ে যাব, সব চেয়ে বড় কথা রবিন আমাকে খারাপ স্টুডেন্ট ভাববে! আর যাই হোক রবিনের মন পেতে হলে গোল্ডেন ৫ আমার চা–ই চাই!
ছোট মামা কেবল জানে ব্যাপারটা — আমি রবিনকে প্রচন্ড ভালবাসি। এলাকার সবাই আমাকে ভাল ছাত্রী হিসেবে চেনে। মাঝে মাঝে আমাদের পাড়ার হলিক্রস স্কুলে পড়া এক ক্লাস জুনিয়র ঝুমুর আমার সাথে প্রতিযোগিতা করতে চায় বটে, কিন্তু ও আমার কাছাকাছি রেজাল্ট করলেও , আমার মত প্রতি বছর ক্লাসে প্রথম হতে পারেনা। আমার শুধু একটাই আফসোস, খিলগাঁওয়ের এক অখ্যাত স্কুল থেকে এস,এস,সি পরীক্ষা দিয়েছি আমি, আর ঝুমুর তো পড়ে হলিক্রসে।
আমি যেরকম ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, সেরকম সুন্দরী । বন্ধুদের কথা বার্তাতে বুঝি , বুদ্ধিমত্বাতেও কম যাই না আমি। প্রতি বিকেলে ছাদে উঠে বসে থাকি রবিনের জন্য। প্রতিদিন ও ওদের বিল্ডিং এর ছাদে পানি দিতে আসে । আমি জানি পানি দেয়াটা ওর মূল উদ্দেশ্য না, ওর ছাদে আসার মূল কারণ হলাম আমি! আসলে রবিন আমাকে না দেখে একটা দিন ও থাকতে পারে না। বুঝিনা ও কেন প্রপোজ করতে এত সময় লাগাচ্ছে? সেই ক্লাস সিক্স থেকে পাড়ার মাস্তান থেকে শুরু করে প্রাইভেট টিউটর—কেউই আমাকে চিঠি না দিয়ে থাকেনি, আমি অবশ্য কাউকেই সেরকম পাত্তা দেইনি। আর তাই বান্ধবীরা আমাকে অহঙ্কারী বলতেও ছাড়ে না!
কিন্তু আমার কি দোষ? রবিন ছাড়া এর আগে আর কোন ছেলেকে দেখে তো আমার বুক এরকম ধুকধুক করেনি। কেন জানিনা,বাসার সামনের রাস্তায় ও যখন ব্যাডমিন্টন খেলতে আসে, আমি জানালার পর্দা সরিয়ে চুপটি করে ওকে দেখি। ওকে প্রাণ ভরে দেখতে কেন যে এত ভাল লাগে আমার!
একদিন সব লজ্জা-শরমের গুল্লি মেরে ছোট মামাকে নিয়ে হাজির হলাম রবিনদের বাসায়! বিনয়ী ব্যবহার আর সুমিষ্ট হাসি দিয়ে ওর মা-বোন, মানে আমার হবু শাশুড়ি আর ননাশকে কুপোকাত করতে মোটেও বেগ পেতে হলনা আমার। কিন্তু যার জন্য আসা,সেই কেবল অনেক দূরে দূরে থাকল। তবে যতটা সম্ভব চোখের অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আর বিভিন্ন ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়ে এলাম, “ওগো রূপবান সুদর্শন যুবক, তোমায় আমি বাসিগো ভাল,বড্ড বেশি ভালবাসি!”
প্রতিদিনকার মত ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। ওপাশের বাসার ছাদে রবিনও এসে দাড়িয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বাম দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে কোথায় যেন নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই দেখতে পেলাম নতুন বিল্ডিং এর চারতলার বারান্দায় ঝুমুর দাঁড়িয়ে আছে! আমার বুকটা অজানা আশংকায় কেঁপে উঠল!
ঝুমুর দেখতে সুন্দরী কিন্তু আমার থেকে বেশি নয়। রাতে বিছানায় শুয়ে আজেবাজে চিন্তায় মনটা বিষিয়ে উঠছিল ক্রমশ। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, নাহ, আর একদিনও দেরী নয়। কাল কোচিং থেকে ফিরেই সন্ধ্যেবেলাতে টেলিফোনে রবিনকে মনের কথা জানিয়ে দেব।
১৯ জুন,২০০৭। সারাদিন প্রচুর পড়াশোনা করলাম। কারণ বিকেলে ম্যাবস কোচিং সেন্টারে পরীক্ষা আছে। তিনটার দিকে ম্যাবস এর সামনে নেমে রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিচ্ছি, ঠিক এরকম সময় রাস্তার অপর পাশের চায়ের দোকানটাতে রবিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পরপর দুইটা হার্টবিট মিস হল আমার!
কীভাবে দোতলায় এসেছি জানিনা। একদিকে যেমন অবাক হয়েছিলাম, আরেক দিকে ভয় আর লজ্জা এসে জেঁকে ধরল আমাকে! লজ্জা ধীরে ধীরে খুশিতে রূপান্তরিত হল। অবশেষে আজ আমার গত ছয়টা মাসের আশা-আকাংখার পরিণতি ঘটতে চলেছে। আজ রবিন আমাকে প্রপোজ করার জন্য ম্যাবস এ চলে এসেছে! ওহ,খোদা, আজ আমার স্বপ্ন পূরণের দিন! পরীক্ষার চিন্তা মাথায় উঠল। আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করছে আমার। এত আনন্দ আর আমি একা সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই ছুটে গেলাম বেস্ট ফ্রেন্ড লিমার কাছে। ওকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ও ঠোঁটে আংগুল রেখে চুপ করতে বলল আমায়। অবাক হলাম। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই লিমা আমাকে দোতলার বারান্দায় নিয়ে এসে বলল, “জাকিয়া, নীচে দ্যাখ”।
নীচে তখন খুব অন্তরংগ ভাবে হেসে হেসে ঝুমুরের সাথে কথা বলছে রবিন! বিস্ফোরিত চোখে কিছুক্ষণ দৃশ্যটা দেখলাম। আমার অনুধাবন করতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগল যে, রবিন আসলে আমাকে নয়, আমার চেয়ে এক ক্লাস জুনিয়র, আমার চেয়ে কম বুদ্ধিমতী, কম সুন্দরী কিন্তু দেখতে মিষ্টি ঝুমুরকে প্রপোজ করার জন্য আজ ম্যাবস এ এসে হাজির হয়েছে!
আজ আমি প্রথম বারের মত ঝুমুরের কাছে হেরে গেলাম—হেরে গেলাম রবিনের প্রতি ঝুমুরের ভালবাসার কাছে! কী নেই আমার, যা ঝুমুরের আছে? কী দেখে রবিন পাগল হল ঝুমুরের জন্য? আমি আর কখনোই বায়োলজি বই নিয়ে ছাদে যাব না, আর কখনও বিকেল বেলা ছাদে দাঁড়াবনা। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলেও মান-সম্মানের ভয়ে ইচ্ছেটা দমন করতে হল। আর কেউ না জানুক,আর কেউ না দেখুক, শুধু লিমা দেখল, আমার দুচোখ বেয়ে হিংসা,রাগ,না পাওয়ার দুঃখ আর হেরে যাওয়ার কষ্ট আগুনের গোলা হয়ে বড় বড় অশ্রু ফোটার মত ঝরে পড়তে লাগল!
- Princess Sushmita
No comments:
Post a Comment