Responsive Ads Here

20 January 2012

প্রায়শ্চিত্ত

কানিজ আর শাহিনের পরিচয় সেই কলেজ থেকে। শাহিন সবসময় চুপচাপ থাকত, বন্ধু বলতে তেমন কেউ ছিল কিনা, ঘোর চিন্তার বিষয় (মনে হয় না কেউ ছিল) সম্ভবত এ জন্যই কানিজের নরম দিলে শাহিনের জন্য হামদর্দী তৈরি হয় যা একপর্যায়ে ভালবাসায় রূপ নেয়। পুরো কলেজ লাইফটাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুজন একসাথে থাকত, মানিকজোড়ের মত। শাহিন মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভুত টাইপের আচরন করত যার কারনে কানিজ ওকে অনেক ভয় পেত, অনেকবার শাহিনকে ছেড়ে দেবার প্ল্যান করলেও কোন এক দৈব কারনে তা আর হয়ে উঠেনি। বেশীরভাগ সময়েই কানিজ মনমরা হয়ে থাকত। পুরাই একটা নিরামিষ প্রেম কাহিনী। যাই হোক, কলেজ শেষে সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যবশত দুজন এক ভার্সিটিতে চান্স পায়নি। তাতে কি ওরা দুজন প্রতিদিনই দেখা করত।

ভার্সিটি জীবনটা কানিজের খুব ভালো ভাবেই কাটছিল। মিতু, নিশা, অনন্ত, শায়ান আর রুদ্রর মত বেশ কিছু ভালো বন্ধু পেয়েছিলো। তবে অন্যদের তুলনায় রুদ্রর সাথেই বেশী ক্লোজ। প্রথমে অবশ্য ছিলনা, কারন ওদের পরিচয়টাই শুরু হয় exam হলের একটা ঝগড়া দিয়ে। ভার্সিটির প্রথম ক্লাশ টেস্ট, রুদ্র কিছুই পড়ে আসেনি, শায়ান শেষ ভরসা, শায়ানের খাতা দেখেই দিব্যি লিখে যাচ্ছে রুদ্র, ফলাফল কিছুক্ষণের মাঝেই স্যারের হাতে ধরা পড়লো রুদ্র, স্যার ধমক দিয়ে বলল, তোমার ID বল, তখন ক্লাশেই স্যার বলেন, এই IDএর ১০% মার্ক কেটে নেয়া হল, ভয়ে হোক আর চালাকি করেই হোক, রুদ্র অন্য একটা ID বলে, সাথে সাথে পেছন থেকে একটা চিকন তবে তীক্ষ্ণ চিৎকার আসে, “স্যার ওটা আমার ID”। ওটা আর কেউ নয়, বেচারা না যেনে কানিজের IDটাই বলেছিল। ক্লাশে তখন হাসির রোল পড়ে যায়, স্যার পরে আর কিছু বলেনি।
সে দিন থেকেই রুদ্র ছিল কানিজের ২চোখের কাঁটা।
রুদ্র আর শাহিন ছিল সম্পূর্ণ উল্টো, রুদ্র সারাদিন বন্ধু, গীটার আর আড্ডা নিয়ে মেতে থাকত। গীটারটা বেশ ভালই বাজাতে পারত, রুদ্রর ইচ্ছে ছিল, কলেজের মত ভার্সিটিতেও ওর একটা বন্ধু মহল থাকবে, একসাথে থাকবে, সন্ধ্যায় সবাই মিলে সঙ্গীত সন্ধ্যার আয়োজন করবে, কিন্তু বিধিবাম, যখনই মিতু, নিশা, অনন্ত, শায়ানদের নিয়ে তা করতে যেত, তখনই সঙ্গীত সন্ধ্যার পরিবর্তে সঙ্গীত সমস্যার সৃষ্টি হত। এক একটার যা গলা ছিলনা, কি বলব!!!
যতই দিন যাচ্ছিল, কানিজ রুদ্রকে ততই নতুনভাবে চিনতে লাগল, যতটা খারাপ ভেবেছিল, ততটা ছিলনা। একদিন study roomএ রুদ্র হাবিবের দ্বিধা গানটা গীটার সহ গাইছিল, সাথে অনন্ত rap দিচ্ছিল “incoming outgoing incoming outgoing”। ব্যাস এইটুকুই। গানটা কানিজের খুব প্রিয় ছিল আর এই প্রিয় গানটাকে অনন্তের মত বেসুরা ব্যাঙ রেপ করছে, ব্যাপারটা মেনে নেয়া গেলনা, টেবিল ছেড়ে উঠে এসেই অনন্তকে একটা রাম ধমক লাগাল, “এমন বেসুরা গলা নিয়া studyতে চেঁচানোর মানে কি” কানিজ ভেবেছিল এইটুকু ঝাড়িতেই কাজ হয়ে যাবে, তবে যা হয়েছিল তা কানিজ কল্পনাও করেনি। রুদ্র তার track change করে একটা সাপুড়েদের বীণের সুর তুলল আর অনন্ত ব্যাঙের মত “ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ” করতে করতে বের হয়ে গেল। প্রথমে অবাক হলেও পরে প্রচণ্ড ভাবে হাসি পায় কানিজের।
Study থেকে বের হয়ে অনন্ত বলছিল, কানিজের মাঝে রস কস কিছুই নাইরে দোস্ত, লেখাপড়া ছাড়া মনে হয়না আর কিছু নিয়া পয়দা হইছে। রুদ্র বলল, ওদের ঘরের বিড়ালটারে এনে ভার্সিটিতে ভর্তি করে দে, দেখবি ওইটাও scholarship নিয়া বের হইছে।
সেমিস্টার শেষে department থেকে পিকনিকের আয়োজন করা হয়। যে যার মত করে মজা করছিলো, এই সময় Principle Dr. Anisul Haq সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখন fresherদের একজন সবার জন্য একটি গান গাইবে বলেই কানিজকে ডাকল। অনন্ত আবারো অবাক, এই মাইয়াটা গানও জানে, পারেনা কোনটা তাইলে??? কানিজ খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়লো, স্যারের সাথে ওদের Familyর অনেক আগে থেকেই পরিচয়, তাই কানিজ সরাসরি স্যারকে বলল ও এখানে নতুন, আর অনেক দিন practice নেই, তাই খালি গলায় গাইতে চাইছেনা। স্যার ওকে আশ্বস্ত করে বলল, দেখত রুদ্রকে খুজে পাওয়া যায় কিনা, কেন জানতে চাইলে স্যার বলেন, কারন ছেলেটা যেখানে যাবে, কিছু না নিলেও গীটার একটা ঠিকই রাখবে।
ঠিক হল খাবার শেষ হলে গান শুরু হবে। কানিজ ভয়ে কিছুই করতে পারছিলনা, পরে রুদ্র এসে ওকে বলল, এটা কোন প্রতিযোগিতা না, ভয়ের কিছুই নেই, এখানে শুধু আমারা আছি, কেউ কিছু বলবে না, সুতরাং শুধু শুধু ভয় পেওনা। আর আমি তো আছি, নাকি। কি যেন একটা নির্ভরতা খুজে পেল অই কথাটার মাঝে।
Stageএ উঠার আগে রুদ্র কানিজের পিঠে প্রায় জোরেই ২টা কি দিয়ে বলল এইটা হল আশীর্বাদ, কেন জানি কানিজ রাগ করেনি ব্যাপারটায়। তবুও শাস্তি স্বরূপ কানিজ Stageএ উঠেই বলল সে “ অই ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায়” গানটা গাইবে, কারন এই ধরনের গান রুদ্র কেন সাধারনত কেউ গীটার দিয়ে বাজায় না, কি আর করা, খুব কষ্ট হল গানটা কভার করতে, তবে মনে মনে হাসল, মেয়েটা পারেও বটে। এইটার পর বেশ কয়েকটা গান গাইতে হল তাকে, সবগুলার মাঝে Blackmore’s Nightএর Ghost of a Rose গানটা যেমন কানিজ গেয়েছিল তেমনি রুদ্রও বাজিয়েছিল। এইসব দেখে ভার্সিটির বেশ কিছু উদীয়মান, প্রতিভাবান এসে তাদের প্রতিভা জাহির করতে লাগল।
দিনটা খুব মজায় কাটল কানিজের, কারন ইতিমধ্যেই বেশ কিছু স্টুডেন্ট এর সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে, রুদ্র তাদের একজন।
তারপর থেকেই কানিজ ফুর্তিবাজদের একজন হয়ে গেল। ক্লাস ফাকি দিয়ে মুভি দেখতে যাওয়া, সকাল থেকে রাত অবধি ঘুরে বেড়ানো, কিছুই বাকি রাখেনি। আর আড্ডার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে গিয়েছিল কানিজ।
রুদ্র আর তার আড্ডার কারনে কানিজ আগের মত করে শাহিনকে সময় দিতে পারতনা। ব্যাপারটা শাহিন মেনে নিতে পারেনা, চিন্তা করতে থাকে কি এমন পাপ সে করেছে যার জন্য কানিজ দূরে সরে যাবে। অনেক চিন্তার পর শাহিন বুঝতে পারল কাউকে খুন করাটা সবচাইতে বড় পাপ। তারপর আবার ভাবল নাহ খুন নয় কোন মেয়েকে ধর্ষণ করাটাই পৃথিবীর সবচাইতে বড় পাপ, তবে এর কোনটাইতো আমি করিনি, তাহলে আমি কানিজকে হারাবো কেন? কোন পাপ না করেই কেন শাস্তি পাব, কেন কানিজকে হারাবো, যদি হারাতে হয়, পাপ করেই হারাবো। শাহিন সারাক্ষণ ভাবতে থাকে কি করবে, কাকে করবে এইসব। এমনিতেই শাহিন একটু চাপা স্বভাবের ছিল বলে কানিজ এসবের কিছুই জানতে পারেনি।
শাহিন তার পাপের উদ্ভোদন করার জন্য একটি চাকু কিনে। কানিজ যখনই ওর বাসায় যেত, কানিজের সাথে বসে খুন আর ধর্ষণের rehearsal করত। প্রথমে কানিজের মুখ বেধে নিত তারপর রেপ আর খুনের অভিনয়। প্রতিদিনই করত, প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও পরবর্তীতে কোন এক অজানা কারনে ভয় পেতে থাকে কানিজ।
এই ব্যাপারটা কাউকে বলবেনা বলবেনা করেও রুদ্রকে সব জানায়। অই কথাতেই ২টা ধাক্কা খায় রুদ্র, কানিজ engaged আর সব কথাবার্তা শুনে শাহিনকে সে একটা Psycho হিসেবে ধরে নিয়েছে, তবে কানিজকে তা বলেনি আর তখনই সে বিদায় না জানিয়েই বাসায় চলে আসে। কানিজ অবাক হয়ে যায় রুদ্রর এমন আচরনে আর রুদ্রও অবাক হয় সে তো কানিজকে ভালবাসেনা, তাহলে তার এমন লাগছে কেন???
সারারাত ভাবল, তারপর ঠিক করল, কয়েকদিন কানিজকে এড়িয়ে চলবে। এর মাঝে নিজেকে ঠিক করে নেবে, কানিজকে ও বন্ধু হিসেবেই রাখবে।
কানিজ আর রুদ্রের মাঝে কিছু একটা হয়েছে, ওরা আলাদা আলাদা থেকে কেন, সমস্ত Department জুড়েই এই একটা কথা। রুদ্র ওকে এড়িয়ে চলছে দেখে কানিজ অনেক রাগ করে, সিদ্ধান্ত নেয়, রুদ্র কথা না বললে সেও বলবেনা।
ঠিক তখনই শাহিনের কল আসে, দেখা করতে চায়। কানিজ শাহিনের বাসায় যায়। শাহিন আগের মতই খুন আর রেপ এর অভিনয় করতে লাগল এবং এক পর্যায়ে সে ২টাই করে ফেলে। কানিজের মুখ বাধা থাকায় রেপ বা খুন কোনটার সময়েই সে চিৎকার করে সাহায্য চাইতে পারেনি।
যখন কানিজের কোন সারা পাওয়া যাচ্ছিলোনা, তখন হুশ ফিরে শাহিনের, কি করল এটা। এখন কি হবে? দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ ধরে পায়চারী করতে করতে সিদ্ধান্ত নিল, রাতের বেলা, ওকে বস্তায় বেধে কোথাও ফেলে আসবে, ঝামেলা শেষ। যে কথা সে কাজ, ঘরে অনেক খুজে একটা বস্তা বের করে আর কানিজকে ওটার ভেতর ভরে গাড়িতে উঠায় । গাড়ি নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় বারিধারা DOHS এলাকাটা খালি দেখে, সেখানেই কানিজকে ফেলে বাসায় আসে। এসেও স্বস্তি পায় না, কে যেন আছে, ভারী একটা নিঃশ্বাস এর শব্দ পায়। বাবা মাকে কিছু না জানিয়েই বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়ে, সারাদিন ঘুরে ঠিক করে, কিছুদিন অন্য কোথাও থাকবে, বন্ধু নেই যে কারো বাসায় থাকবে, তাই কুরিল বস্তিতেই একটা রুম নেয়, রাস্তার পাশে, যেন যে কোন মুহূর্তে পালাতে পারে আর পুলিশের গাড়ি আসলে যেন আগেই জানতে পারে।
অইদিকে রুদ্রও বুঝতে পারে তার কাজটা ঠিক হয়নি, তাই sorry বলার জন্য কানিজকে অনেক বার কল দিয়েও পায় না, পরদিন ভার্সিটিতে এসে খুজ নেয়, সে নেই। কি করবে ভেবে পায় না।
সকালবেলায় কানিজের লাশ পায় পুলিশ, কানিজের পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসল। কানিজের বাবা পুলিশকে বলল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে সামনে আনতে হবে। অহ কানিজের বাবার পরিচয়টা দেয়া দরকার। কানিজ দিতে পছন্দ করতনা, তাই প্রথমে দেইনি, এখন দিতে হবে, উনি ঢাকার খুব বড় সাইজের একজন রাজনৈতিক নেতা, বোনাস হিসেবে একজন নামকরা Business Man.
পুলিশ কিছুই বুঝতে পারছিলনা কি করবে, তখন গেল কানিজের ভার্সিটিতে, যদি কোন খবর পাওয়া যায়, সেখানেই কানিজ আর রুদ্রের বন্ধুত্ব আর তাদের কিছুদিনের ঝগড়ার কথাও জানল। কি আর করা, রাজনৈতিক মহলের চাপ কমানোর জন্য পুলিশ রুদ্রকে ধরে নিয়ে আসলো। রুদ্র ছিল একটা নিরীহ পরিবারের নিরীহ ছেলে। থানায় আনার পর অনেক চেষ্টা করেও রুদ্রর সাথে ওর বাবা মা দেখা করতে পারেনি। জেলে আসার ৫-৬ ঘন্টা পর রুদ্র জানতে পারে কেন ওকে ধরে আনা হল। তখন নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার কথা বাদ দিয়ে চিন্তা করতে লাগল, কেন তখন কানিজকে সাবধান করলাম না, কারন আমি তো বুঝতে পেরেছিলাম শাহিন একটা Psycho. নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগল। এক সময় নিজেকেই কানিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে হতে লাগল। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো তখন।
কানিজের বাবার কানে খবর পৌঁছানোর পর তিনি হুকুম দিলেন, আমার মেয়ের খুনির বিচারের জন্য আমি অপেক্ষা করতে পারব না, তখন পুলিশকে বললেন, যা চাও পাবে, ওকে আজ রাতেই কোথাও নিয়ে মেরে ফেল। নয়ত একটারও চাকরি থাকবে না।


সেই রাতেই পুলিশের একটি ভ্যানে করে রুদ্রকে নিয়ে একটি নির্জন গলিতে দাড়ায়, একটু পরেই গুলি করবে, তখন রুদ্র পুলিশটিকে জিজ্ঞেস করে, “যার অপরাধের শাস্তি আমি পাচ্ছি, সে কি কোনদিন তা জানবে আর জানলে কি প্রায়শ্চিত্ত করবে???”
স্বভাবতই পুলিশটি নির্বাক ছিল, আর ঠিক তখনই রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটি বুলেট এসে রুদ্র বুকে আঘাত করে, চিৎকার দেবার সময় পায়নি, তার আগেই লুটিয়ে পড়ে সে। আর এই রাস্তার পাশের ঘরটিতেই শাহিন থাকত।
************************************************
অনেকদিন পর শাহিনকে তার বাবা মা খুজে পায়, তবে তখন তাকে normal বলা যায় না। শুনেছি শাহিন নাকি এখন ঢাকারই কোন একটা private clinicএ ভর্তি আছে, মাঝে মাঝেই চিৎকার করে বলে, “ও যা করেছে তার শাস্তি পেয়েছে, আমি প্রায়শ্চিত্ত করবনা, বলেই জ্ঞান হারায়”

.,..,,.,.,.,..,..
লিখেছেন-Rudro Rahman

No comments:

Post a Comment