খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে, সবার মুখেই আনন্দের হাসি। দিনরাত মিলিয়ে কাজ করেও কারও মাঝে এতোটুকু ক্লান্তি দেখা যাচ্ছেনা।পুরো বাড়িটা রংবেরঙের আলোতে ঝলমল করছে, আলপনাগুলো এতো সুন্দর হয়েছে যে একবার তাকালেই একটা অন্যরকম ভাললাগা কাজ করছে। ১০ বছর বয়সী মেয়ে থেকে শুরু করে ৪০ বছরের মহিলা পর্যন্ত সবাই এমনভাবে সেজেছে যে আজ তাদের কারোরই প্রকৃত চেহারা আমি অনুমানও করতে পারছিনা। তাজা ফুলের সুবাস আসছে চারিদিক থেকে, ঢাকা শহরের সব ফুলই বোধহয় হাজির হয়েছে রিফাত আর ঊর্মির আদরের সোনামণিকে আশীর্বাদ দিতে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিফাত এবং ঊর্মি, আর আজ ওদের মেয়ে সাইকার বিয়ে। রিফাত ও ঊর্মি শুধু আমার বন্ধুই নয় তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু তাইতো প্রায় ২৮ বছর পর স্ত্রী-সন্তান সবাইকে নিয়ে দেশে এসেছি কেবল ওদের অনুরোধ ফেলতে না পারার কারণে। এতদিন পর দেশে ফিরে আজ ২৮ বছর আগের একটি বিয়ের অনুষ্ঠান এর কথাই কেবল বারবার মনে পড়ছে। পড়বে নাইবা কেন, ওই বিয়ের অনুষ্ঠান ই যে ঘুরিয়ে দিয়েছিল আমার জীবনের গতিপথ।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমাদের একটা বিশাল বড় ফ্রেন্ড সার্কেল ছিল। এমন কোন দিন ছিলনা যেদিন আমরা কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা ক্যাফেটেরিয়াতে বসে আড্ডা মেরে কাটাইনি। পড়াশুনাতে যেমন একজন আরেকজনকে যথাসম্ভব সহযোগিতা করত, ফাঁকি দেয়াতেও কম করতনা। তাইতো কেও একজন যদি ক্লাস এর পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছে তো সেইদিন অবধারিতভাবে অন্য আর কারোরই ক্লাস করা হতোনা। যদিও ক্লাসের ফাস্টবয় হওয়ায় রাহাদের ক্লাস ফাঁকি দিতে একটু কষ্টই লাগত কিন্তু বন্ধুত্বের কাছে সেই কষ্ট কোনসময়ই পাত্তা পেত না। আর ক্লাস পালানোতে আমি একমাত্র আমার ফ্রেন্ড সার্কেলেই দেখেছি যেখানে মেয়েরা ক্লাস ফাঁকি দেয়াতে ছেলেদেরকে হার মানাত।
বন্ধুর বিপদে বন্ধুর এগিয়ে আসার ক্ষেত্রেও বোধহয় আমাদের কোন জুড়ি মেলা ভার। তাইতো একবার পরীক্ষার দিন অসুস্থ থাকায় রিপাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছিল বলে তামান্নাও পরীক্ষা না দিয়ে ফেল করেছিল। জনি আর সোমেল তো একবার একই মেয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। একেবারে জানের দুশমন হয়ে গিয়েছিল একজন আরেকজনের (পরে অবশ্য দুইজনই ছেঁকা খেয়েছিল), তবে বন্ধুত্ব অটুট ছিল সবসময়। লাবণ্য তো ভুল করে ক্লাসের প্রথম দিন আমার রোল নাম্বারে attendence দিয়ে কি লজ্জাটাই না পেয়েছিল। মাঝে মাঝে আমরা ছেলেরা রাতেরবেলা মেয়েদের হলের পুকুর পাড়ে বসে গান-বাজনা করতাম আর মেয়েরা রুমের বাতি নিভিয়ে দিয়ে টর্চ লাইট মেরে জানান দিত যে তারাও আমাদের সাথেই আছে। রিফাত অসম্ভব ভাল গান গাইত, আমরা প্রায়ই বিকেল বেলা নৌকা ভ্রমনে যেতাম আর পুরটা সময় রিফাতের গান চলত। হঠাৎ একদিন শুনি রিফাতের নাকি ঊর্মির সাথে রিলেশন হয়ে গেছে। ঊর্মি আমাদের ক্লাসেরই মেয়ে, একটু চুপচাপ স্বভাবের হওয়ায় এতদিন আমাদের সাথে তেমন ক্লোজ ছিলনা, তবে খুব ভাল কবিতা আবৃত্তি করত মেয়েটা। দুজনই সাংস্কৃতিক মানসিকতার হওয়াতেই বোধহয় সহজেই ওদের রিলেশনটা হয়েছিল। সে যাই হোক প্রেম হল রিফাতের কিন্তু বেশি খুশি হলাম আমরা, কারন একদিনেই কোন বন্ধুর পুরো মাসের খরচ খেয়ে সাবাড় করার সুযোগ তো আর বারবার আসেনা। ধীরেধীরে ঊর্মিও আমাদের সার্কেলএরই একজন হয়ে গেল। দেখতে দেখতে আমাদের ফায়নাল ইয়ার চলে এল। লাবণ্য হল আমার ফাইনাল ইয়ারের থিসিস পার্টনার। আমাদের থিসিস সুপারভাইজার স্যার একটু কড়া হওয়ায় এবার আর আমরা ফাঁকি দিয়ে পার পেলাম না। ল্যাব, লাইব্রেরী, এসাইনমেন্ট, রিপোর্ট করতে করতে আমাদের দুজনের দিন-রাত এক হয়ে গিয়েছিল। বেশি কষ্ট লাগত যখন দেখতাম সবাই আড্ডা মারছে আর আমরা ল্যাব এ বসে কাজ করছি। তবে ধীরে ধীরে সময়টা ভালোই লাগা শুরু হল। থিসিসের কাজে একজন আরেকজনকে যথাসম্ভব সহযোগিতা করতাম,কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমরা নানা বিষয় নিয়ে গল্প করতাম, দুজনের চিন্তা-ভাবনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সবকিছুই শেয়ার করতাম। তবে বেশি ভাল লাগত ল্যাবে যেদিন বেশি কাজ থাকতো সেইদিন, কেননা লাবণ্য ওইদিন আমার জন্য রান্না করে দুপুরের খাবার নিয়ে আসতো। ওর ভুনাখিচুড়িটা দারুন হত। আমি প্রায়ই ওকে বলতাম আমার বউকে তোর কাছে ভুনা-খিচুরি রান্না শেখার জন্য পাঠাব, শিখায়ে দিস। লাবন্য উত্তরে দেখতাম শুধুই একটা মিষ্টি হাসি দিত, কখনই কিছু বলত না। কারও হাসি যে এতো মিষ্টি হতে পারে লাবন্যকে না দেখলে বোধহয় আমি কোনদিন ভাবতেই পারতাম না। দেখতে দেখতে আমাদের থিসিস শেষ হয়ে গেল, রেজাল্ট বের হল আর সেই সাথে শেষ হল আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়। তবে আনন্দের বিষয় ছিল যে আমরা পরবর্তীতেও সবাই সবার সাথে যোগাযোগ রাখতাম। ছুটির দিনে প্রায়ই একত্র হয়ে ফিরে যেতাম পুরনো দিনগুলোতে। এরই মাঝে একদিন দুপুরে অফিস এর রিসিপসন থেকে আমাকে জানানো হল আমার গেস্ট এসেছে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম কারো তো আসার কথা ছিলনা, পরিচিত কেও হলে তো ফোন দেয়ার কথা। যাই হোক আমি গিয়ে দেখি লাবন্য বসে আছে।
আবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম "কিরে তুই?"
- "হ্যাঁ, একটা খবর দিতে এলাম। ফোনেই বলা যেত কিন্তু আমি তোকে সশরীরে জানাতে চেয়েছিলাম, তাই তোর অফিস এ আসা। সারপ্রাইজ দেব বলে আগে কিছুই জানাইনি।"
-ওহ আচ্ছা, কি খবর?
-আগামী মাসের ৪ তারিখে আমার বিয়ে। হঠাৎ করেই ঠিক হয়ে গেছে। ছেলে জার্মানিতে থাকে, ১ মাসের জন্য দেশে আসবে। হয়ত ২-৩মাস পর আমাকেও নিয়ে যাবে।
-বাহ, তুইতো তাহলে ইউরপিয়ান হয়ে যাচ্ছিস.........
-হুম। বিয়ের পর হয়ত আর তোদের সাথে সেভাবে দেখা হবে না। তাই আমি চাই তোরা বিয়ের কয়েকদিন আগেই চলে আসবি। কয়েকটা দিন আবার আগের মত করে কাটাব আমরা।
আমি ওকে কথা দিলাম যে আমরা সবাই কয়েকদিন আগেই ওদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হব।যথারীতি আমি, রিফাত,জনি,রাহাদ, সোমেল সবাই একসাথে আগের মাসের ৩০ তারিখে রওনা হলাম লাবন্যর গ্রামের বাড়ি খুলনার উদ্দেশ্যে। গিয়ে দেখি ঊর্মি,তামান্না,রিপা ওরা আগেই এসে হাজির।ঊর্মিকে দেখে রিফাতের খুশি তো আর ধরে না। পরবর্তী কয়েকটা দিন যেন স্বপ্নের মত কাটল। ।তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম লাবন্য সবসময়ই কেমন যেন মন খারাপ করে থাকছে। তামান্নাকে জিজ্ঞাসা করতেই ও বলল," সব মেয়েরই বিয়ের আগে একটু মন খারাপ হয়,তবে বিয়ের দিন দেখিস মন ভাল হয়ে যাবে।" আমাদের সার্কেলের প্রথম কারো বিয়ে, তাই আমরা সবাই এতটাই আনন্দিত ছিলাম যে বিয়ের প্রতিটা কাজেই আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহন করছিলাম। লাবন্যর গায়ে হলুদের দিন যখন ওর মুখে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছিলাম ঠিক তখনই আমার বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা চাঁপা কান্না শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমি এতোটাই বোকা যে সেটাকে প্রিয় বন্ধুর বিদায় মনে করে সেদিন এড়িয়ে গিয়েছিলাম।
বিয়ের দিন সকাল থেকেই কেন যেন আমার ভেতরে কোথাও একটু থেকে থেকেই হাহাকারের সুর বেজে উঠতে লাগল, কোন কিছুই করতে ভাল লাগছিল না। শুনলাম সন্ধ্যা ৭ টার দিকে বরযাত্রী আসবে, ৯ টার মধ্যেই সবকিছু শেষ করে লাবন্যকে নিয়ে যাবে ওরা। সন্ধ্যার কিছুক্ষন আগে কি কাজে যেন আমি বাড়ির ভিতরে গিয়েছিলাম, হঠাৎ যে রুমে কনে বসে ছিল সেই রুমের দিকে চোখ গেল আমার আর আমি তখনই আবিষ্কার করলাম আমার হাহাকারের সুরের উৎস। বধুর সাজে লাবন্যকে দেখা মাত্র আমি চিনতে পারলাম সেই অপ্সরীকে যে আমার স্বপ্নের ভুবনকে সবসময় রাঙিয়ে রাখে। যার পাখায় ভর করে আমি হারিয়ে যাই কল্পলোকের অচেনা কোন ভুবনে, যাকে দেয়ার জন্য আমার রোজ একগাদা লাল গোলাপ কিনতে ইচ্ছা করে, যাকে আমি আমার মনের মন্দিরে দেবী বানিয়ে পূজা দেই, যাকে আমি হেলেন বানিয়ে প্রতিনিয়ত প্রস্তুতি নিচ্ছি ট্রয় নগরী জয়ের,সে তো আর কেও না,সে তো লাবন্য। হায় অমিত তুমি, যার জন্য তিল তিল করে তোমার সমস্ত ভালবাসা জমিয়ে রেখেছ, সেই লাবন্যকে তুমি এতো কাছে পেয়েও কখনও বুঝতে পারনি?
আমি আমার চারপাশে তখন শুধুই অন্ধকার দেখতে পেলাম, নিজের প্রতি এতটাই ঘেন্না হচ্ছিল যে বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা কয়েক মিনিটের জন্য হারিয়ে গেল। বুঝলাম আমার লাবন্য যদি হারিয়ে যায়, আমি কোনদিনই আর অমিত হতে পারব না। কিন্তু একবার শেষ চেষ্টা হিসেবে পাগলের মত ছুটে গেলাম বন্ধুদের কাছে, বললাম সবকিছু। কিন্তু তখন বরপক্ষ আসতে আর বড়জোর ১ঘন্টা বাকি, কারোরই কিছুই করার নেই। রিফাত ঊর্মির সাথে যোগাযোগ করে লাবন্যর সাথে কিছুক্ষন একা কথা বলার সুযোগটুকুই শুধু করে দিতে পেরেছিল।
যে লাবন্যর সাথে আমি এতো সময় কাটিয়েছি সেই লাবন্যর সাথে কথা বলতেই সেদিন আমার কতটা সংকোচ হচ্ছিল তা কেবল আমিই জানি। আমি লাবন্যর সামনে গিয়ে কি বলব তা আমার নিজেরই জানা ছিলনা। তবে মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয় আমার সেদিন তাই হয়েছিল। বেশিকিছু না ভেবেই আমি মুখোমুখি হই লাবন্যর। কিন্তু সেদিন লাবন্য আমাকে শুধু একটি কথাই বলার সুযোগ দিয়েছিল আর তা ছিল সারাজীবন ওর হাতের রান্না করা ভুনাখিচুড়ি খাওয়ার আবদার। কথাটি বলার সাথে সাথেই দেখলাম আমার লাবন্যর চোখের কোনে জ্বল চিকচিক করছে..................
বিঃ দ্রঃ সেই রাতেই লাবন্যর বিয়ে হয়েছিল তবে রাত ৯ টায় নয় সন্ধ্যা ৬ টায়..................
লিখেছেন- শিশির
No comments:
Post a Comment