Responsive Ads Here

18 January 2012

ভুতুরে গল্প-১

আজ সকাল থেকেই আকাশের অবস্থা খারাপ। যেকোনো সময় ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামবে। বছরের এই সময়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বৃষ্টি হবার কথা নয়। হয়তো কয়েক ফোঁটা ঝরে বন্ধ হয়ে যাবে। মিলির মতো হয়তো আকাশেরও আজ মন খারাপ। মানুষের চেয়ে আকাশ এই দিক দিয়ে একটু আলাদা। একটা সাধারন মানুষ ইচ্ছে হলেই কাঁদতে পারে না। কিন্তু আকাশ পারে। সব কষ্টগুলো কান্নার বৃষ্টি আকারে ঝরিয়ে দেয়। এরপর সূর্যের আলোতে ঝলমল করে হাসে।

মিলি বৃষ্টি পছন্দ করে। শুধু পছন্দ করে বললে ভুল হবে। ও বাসায় ছিল, বৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু মিলি ছাদে উঠে বৃষ্টিতে গাঁ ভেজায় নি, এমন কোনোদিন হয়নি।

তবে আজ মিলি মনে প্রানে চাচ্ছে যেনও বৃষ্টিটা না হয়। প্রায় ১০ বছর থাকার পর আজ তারা তাদের পুরনো বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় উঠছে। মিলির জীবনের প্রথম বাড়ি বদলের অভিজ্ঞতা। প্রথম প্রথম খুব এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছিলো। সাথে ছিল প্রিয় বাড়িটা ছেড়ে চলে যাওয়ার দুঃখ। দুঃখটাই প্রবল হয়ে গ্রাস করেছিলো তার হৃদয়টাকে। এতদিনের চেনা জানা পরিবেশ ছেড়ে যাওয়া আসলেই কষ্টের। বারবার ঘাড় ঘুড়িয়ে নিজের হাতে করা বাগানটা দেখছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে ওর। কষ্ট হচ্ছে কান্নাটাকে আটকে রাখতে।

মিলিরা তাদের নতুন বাড়িতে যখন পৌঁছায় তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে।

মফঃস্বল অঞ্চলের ২ তলা বাড়ি। অনেকটা বাংলো টাইপের। বাড়ির নামটি ইংলিশে লেখা। বাংলা করলে দাঁড়ায় “এক টুকরো স্বর্গ”। চারপাশে গাছগাছালি পরিবেষ্টিত। দিনের আলো সেই গাছপালা বেধ করে খুব একটা ভেতরে ঢুকতে পারছে না। বাড়িটা প্রথম দেখাতেই অপছন্দ হল মিলির। এটা কোনও বাড়ি হল? আশেপাশে ত্রি সিমানায় কোনও বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে না। কারো সাথে যে গল্প করবে এমন মানুষ খুঁজে পাবে কই সে? আর তাছাড়া বাবা সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত। মা ব্যস্ত ঘর আর ঘরের কাজ কর্ম নিয়ে। মনটা বিষাদে ভরে উঠলো মিলির। তার সদা চঞ্চল মনটাতে কে যেনও পিচ ঢেলে দিল।

তাদের সাহায্য করার জন্য মিলির মামা এসেছিলেন। এই এলাকায় তিনি গত ৩ বছর ধরে আছেন। উনাকে মিলির খুবই পছন্দ। ভদ্রলোক ভীষণ হাসিখুশি। সব সময় মজা মশকরা করে থাকেন। মিলির বিষাদে ছেয়ে যাওয়া চেহারা দেখে যা বুঝার বুঝে নিলেন। তাকে অভয় দিয়ে বলতে লাগলেন, নতুন পরিবেশ। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই মানিয়ে নিতে পারবে সে। তখন আর তেমন বিরক্ত লাগবে না। বরং কোলাহল মুক্ত এমন সুন্দর নির্জন বাড়িটা তখন আরও ভালো মনে হবে। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়েছে মিলি। আর কিছু বলেনি।

সেই বাড়িতে প্রথম রাত্রি।

ছোট মামা সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে প্রায় ৮ টার দিকে বিদায় নিলেন। বাবা অফিস থেকে ফিরেন রাত ৯ টা ১০ টার পর। বাংলাদেশের সুনামধন্য একটি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের নবনিযুক্ত চীফ এক্সিকিউটিব হয়েছেন তিনি গত মাসে। অফিসের অর্ডারে এখন শিফট করেছেন নতুন শহরে। এই শাখার সমস্ত দায়ভার এখন তার উপর। অফিসে কাজের চাপও বেড়ে গেছে কয়েকগুন।

সন্ধ্যা নাগাদ মোটামুটি কাজকর্ম, ঘরদোর গুছিয়ে ফেলা হয়েছিলো। বাসায় খাবার ঘর, বসার ঘর মিলিয়ে রুম সর্বমোট ৬টি। নিচ তলায় বসার ঘর, রান্না ঘর, এবং খাবার ঘর। আর উপর তলায় ৩ টি বেডরুম আর একটি পড়ার রুম। পড়ার রুম মিলি নিজের মতো সাজিয়ে নিলো। বাসায় থাকাকালীন সময়ের বেশীরভাগ সময় সে পড়ালেখা করে কাটায়। পড়ার রুমের সাথে লাগোয়া একটি বারান্দা। বারান্দায় মিলি নিজের ব্যাবহার করা ইজি চেয়ারটা বসালো। পড়ার টেবিলটা বারান্দার দরজার ঠিক পাশে। আর একটু দূরে তার ব্যাবহারের কম্পিউটারটা।

খাওয়ার টেবিলে ওরা ৩ জন। কাজের মেয়েটা খাবার পরিবেশন করছে। মিলির বাবা সুলতান সাহেবের কড়া নির্দেশ রয়েছে যে, আর কোনও বেলা না হোক তবে রাতের খাবার সবার একত্রে বসেই খেতে হবে। কেউ মারাত্মক অসুস্থ থাকলে অবশ্য তার জন্য এই নির্দেশ কিছুতা শিথিল করা হয়।

সুলতান সাহেব কথাবার্তা একটু কম বলেন। এই জিনিসটা উনি উনার বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। উনার বাবা বলতেন, কথা বেশি বলা হল মেয়ে মানুষের স্বভাব। কথা বলতে হবে মেপে। পেট পাতলা এবং বাঁচাল স্বভাবের পুরুষমানুষ জীবনে উন্নতি করতে পারে না। সুলতান সাহেব এই শিক্ষা সেই ছোট বেলা থেকেই পালন করে আসছেন। তিনি এখন একজন সফল পুরুষমানুষ।

আজকে তিনি নিয়ম ভঙ্গ করলেন। বেশ ফুরফুরে গলায় মিলিকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন লাগছে রে মা?”

মিলি বাবার কাছ থেকে হটাত এই প্রশ্ন আশা করে নি। তবে বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। দ্রুত সামলে নিলো। বলল, “ভালোই লাগছে বাবা। তবে এতো বড় বাড়ি, কিন্তু মানুষ মাত্র ৪ জন। তাই কেমন যেনও খালি খালি লাগছে।”

সুলতান সাহেব আশ্বস্ত করে বললেন, “আরে প্রথম দিন দেখে এমন লাগছে। দেখবি অভ্যস্ত হয়ে গেলে খারাপ লাগবে না। কোলাহল থেকে দূরে এমন একটি বাড়ি সবার কপালে জোটে না। আমরা আসলে লাকি!”

এরপর আর তেমন একটা কথা হলো না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করলো সবাই।

মিলি বিছানায় গেলো রাত ১১ টার দিকে। বাবা-মা আরও আগেই শুয়ে পড়েছে। সবাই খুব ক্লান্ত। শোওয়ার পর উনাদের রুম থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য, মিলির রুমের পরে একটা রুম ফাঁকা, তারপরের রুমে উনারা শুয়েছেন। বিশাল আকারের রুমগুলো বেধ করে শব্দ আসার কথাও নয়।

নতুন বাড়িতে প্রথম রাত। স্বাভাবিক ভাবেই মিলির একটু অস্বস্তি লাগছিল। কাজের মেয়েটা নিচে রান্নাঘরের পাশে শুয়েছে। তার সাথে খানিকক্ষণ কথা বলে আসলে হয়তো ভালো হতো। কিন্তু এতরাতে আর নিচে নামতে ইচ্ছে করলো না। তারপর একসময় চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো সে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো।

মিলির আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যায় রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে। প্রথমে অপরিচিত পরিবেশে মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হয়। আজকেই প্রথম এসেছে বাসাতে। অচেনা চারিধার। মিলির একটা বদ অভ্যাস আছে। ঘরে বাতি না থাকলে ঘুমুতে পারে না সে। তাই বাকি সব প্যাকিং খোলা না হলেও তার ঘরের ডিম লাইটটা ঠিকই লাগানো হয়েছিলো। হটাত ঘুম থেকে উঠায় খেয়াল হল, ঘরে কোনও আলো নেই। হয়তো কারেন্ট চলে গেছে, বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিল মিলি। কিন্তু খানিক বাদেই চমকে উঠলো। তাহলে, ফ্যান ঘুরছে কিভাবে? আই পি এস এখনো কানেকশন দেয়া হয় নি! আর আম্মু বা আব্বু যে বাতি বন্ধ করবে তার প্রশ্নই আসে না। কারন উনারা জানেন যে মিলি অন্ধকারে ঘুমুতে পারে না। বাতি না দেখলে অবশ্যই ভয় পাবে।

মিলি আসলেই ভয় পেলো। আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে মোবাইলের আলোতে একটু একটু আগায় সে। সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে টিউব লাইটের বাতিটা চেপে দেয়।

ক্ষণিকের জন্য বোবা হয়ে যায় মিলি। তার বিছানার উপর পা দুটোকে গুটিসুটি মেরে কেউ একজন বসে আছে। একটি মেয়ে। চুল দিয়ে মুখ ঢাকা। শুধু হাত দুটো দেখা যাচ্ছে। ফ্যাঁকাসে রঙ্গের হাত। অনেকদিন রক্তশূন্যতায় ভুগলে যেমন হয়, তেমনই। মিলি তার দিকে ঘুরতেই নিজের একটা হাত মিলির দিকে বাড়িয়ে দিলো মেয়েটি। অনেকটা কারো হাত ধরার জন্য আমন্ত্রন জানিয়ে যেভাবে হাত বাড়িয়ে দেয় কেউ তেমন করে।

আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো মিলি। কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু মুখ দিয়ে গোঙানির মত আওয়াজ ছাড়া কিছু বের হল না। এক সময় প্রচণ্ড ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।

(চলবে)

No comments:

Post a Comment