Responsive Ads Here

19 January 2012

ফোন

ভালবাসা ব্যাপারটাই রুদ্রর কাছে অচেনা ছিল। দেখত বন্ধুরা প্রেম করছে...তখন সে ভাবত "নাহ!! একেবারে নিজের একটা মেয়ে...তার কথা সবসময় ভাবা...তাকে নির্দ্বিধায় দেখা, খারাপ না!!" কিন্তু প্রেম কেন জানি করা হয় নি। সেটা রুদ্রর খুতখুতা স্বভাবের জন্যই হবে হয়তো। আর মেয়ে পাওয়াও তো অতো সহজ না!

যাই হোক ...দিন তো আর থেমে থাকে না। SSC পাশ করে কলেজে ভর্তি হোল রুদ্র। কলেজ মানেই মুক্ত মুক্ত একটা ভাব...কিশোর মনের তরতাজা নতুন অনুভূতি গুলো পাখা মেলা... ভালবাসার হালকা একটা সুবাস নাকে আসা। রুদ্রর ও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। খুব স্বাভাবিক, আর দশটা ছেলের মতনই ছিল সে।

দেখা পেলো সে জেবার! অনিন্দ্যসুন্দরী,মিষ্টি চোখের এই মেয়েটি কলেজ এর সবার চোখ আকর্ষণ করলেও রুদ্রর মনের ভিতরে যে অনাবিল একটা সাগর রয়েছে...তাতে মুক্তোর মতো বৃষ্টি কনা হয়ে এল জেবা। একটা মানুষ কি করেই বা পারে মুহূর্তের মাঝে আরেকটা মানুষের সব হয়ে যেতে? রুদ্র বুঝে পায় না। কিন্তু সে জানে,জেবা শুধু তার। কিন্তু বলা হয়ে উঠেনা জেবাকে। জেবাও মনে হয় একটু অহঙ্কারি,রুদ্রর চেহারা যথেষ্ট আকর্ষণীয় হলেও,তাকে বিশেষ কোন প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখে না জেবা। রুদ্র শুধু চেয়েই থাকে...আর নিজের প্রতিটা মুহূর্ত বিসর্জন করতে থাকে জেবাকে! হয়তো কথা সরাসরি কখনও হয়নি...কিন্তু জেবার প্রতিটা কথা কান পেতে শোনার চেষ্টা করত রুদ্র। প্রতীক্ষার মাঝেও ছিল একতরফা ভালবাসা দেয়ার এক অসামান্য আনন্দ!

কিন্তু এভাবে কতদিন? মনের প্রতিটা কোনায় যার অবস্থান,যাকে নিজের প্রতিটা মুহূর্ত দান করে দিয়েছে রুদ্র; তাকে নিজের কোরে না নেয়ার কষ্ট তো অপিরিসীম! ছটফট করতো রুদ্র,মনের ডানা গুলি নির্জীব হয়ে পড়ে থাকত গহীনে!! এমন দুঃসময়ে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হোল জেবার সবথেকে ঘনিষটো বন্ধু অন্তু। রুদ্রর সাথেও তার ভালই ভাব ছিল। কিন্তু ফোন দেয়ার মতো না। সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ অন্তুর ফোন দেখে বুকটা ধক করে উঠল রুদ্রর!

:হ্যালো!
:হুম ...অন্তু!
:কেমন আছ রুদ্র?
:এই ত...তুমি?
:আছি। আমার ফোন পেয়ে তুমি অবাক হও নি?
:সত্যি বলবো? হয়েছি।
:আমি জানি।
:কি জান? (রুদ্র যা বোঝার বুঝে ফেলেছে)
:সবাই বুঝে রুদ্র! আর আমি জানি এবং বুঝি!
:হুম।
:বলে ফেলো জেবাকে...কতদিন এভাবে চেপে রাখবা?
:কি করতে বল?
:ঐ যে? বলে দাও ওকে!
:আমি পারব না!
:কেন? নিজের কথা বলতে এত ভয়?
:ভয় নিজের জন্য না...ভয় অপমানিত হবার।
:হুম।এইটা ঠিক। ও খুব অহংকারী। রিফিউজ করলে ব্যাপারটা ভাল দেখাবে না। লোকে হাসবে।
:কি করবো বলত?
:আমি বলবো!
নিজের কান কে বিশ্বাস করতে কষ্ট হোল রুদ্রর!
:কি বল?
:হুম। ফোন কাট। আমি ওকে কালই বলবো।
:ওকে।

জেবা কে কথাটা বলার পর জেবা দেখল রুদ্রকে!ভাল করে। কিশোর মনের অপরিপক্ব কিশলয়ে যেন একটা কিসের হাওয়া লেগে গেল!! এই চোখ, এই কণ্ঠ! রুদ্রর ধারালো ব্যাক্তিত্ত জেবার মন আচ্ছন্ন করে ফেললো। নিতান্ত অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়ে রাজী হয়ে গেলো জেবা! কিন্তু ব্যাপার টা শেষ হোল না এখানে...
হঠাৎ করে রুদ্রর প্রতি অন্তুর এই সহানুভূতি কিন্তু স্বাভাবিক ছিল না,থাকার কথাও না। চিনে না,জানে না, একটা ছেলেকে এভাবে ব্যাক্তিগত ব্যাপারে সাহায্য করা অস্বাভাবিক। এর পিছনে কারণ ছিল। রুদ্রকে মনেপ্রাণে ভালবেসেছিল অন্তু ও!! তাই রুদ্রর সুখদুঃখের সাথি হয়ে জেবার জায়গাটা নেয়ার চেষ্টা ছিল তার।
কোথা থেকে কি হোল! রুদ্র আশা ভঙ্গ হোল। সে জানলো জেবার অন্য কোথাও সম্পর্ক রয়েছে। আর নিতান্ত ভীরু, শান্ত মেয়ে জেবা জানলোও না, তার প্রাণের বান্ধবী তাকে কীভাবে বঞ্চিত করল! জেবা জানলো, রুদ্র আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে তার প্রতি!
গল্প শেষ হতে পারত এখানেই! কিন্তু হোল না!মানুষের জীবন যে বড় বিচিত্র!!...
রুদ্রর মনের গভীরের গভীরতম স্থান দখল করলো অনন্যা... হঠাৎ করে নয়, দীর্ঘদিনের বন্ধুত্তের মাঝ দিয়ে তারা একজন আরেকজনের হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুর প্রতি বন্ধুর নির্ভরশীলতা,বিশ্বাস ভালবাসা সব কিছুর অসম্ভব সুন্দর মিশেল ঘটেছিল তাদের বন্ধুত্তে। একজন কে ছেড়ে আরেকজনের থাকা অসম্ভব ছিল প্রায়!অনন্যা জানত জেবার কথা,রুদ্রর মনের শক্তিশালী অনুভূতি দেখে তার জন্য অনন্যার ছিল অপরিসীম স্রদ্ধা...আর এই স্রদ্ধাই ছিল ভালবাসার বীজ। রুদ্রকে ভালোবেসে ফেলার ব্যাপারটি অনন্যা বুঝে ফেলেছিল,কিন্তু যখনই ভেবেছে বলবে, তখনই জেবা যেন মূর্তিমান হয়ে ফুটে উঠত তার চোখের সামনে।
কিন্তু রুদ্র বুঝেছিল, অনন্যা কে ছাড়া তার চলবে না। এবং তাকে ছাড়াও যে অনন্যার চলবে না, এ কথাও সে ভালোভাবেই বুঝেছিল ।

:অনন্যা?
:বল!
:তুই কি রাঁধতে পারিস ঠিক ঠিক বলত?
:কেন? খেতে চাস?
:আরেহ! পাগল নাকি? আত্মহত্যা করতে যামু? এত তাড়াতাড়ি আমার মরার শখ নাই!!
:ও!! তাই? আমার ইচ্ছা আছে...
:ক্যান?
:জানিনা...বাদ দে...কি যেন বলছিলি?
:কি রাঁধতে পারিস?
:নুডুলস !
এক মুহূর্ত নীরব রুদ্র।
:ওই রুড!
:হুম
:কই গেলি?
:আছি তো। একটা কথা রাখবি?
:বল। তোর কথা আমি ফেলেছি কোনদিন?
:ভয় হয়...
:কিসের ভয়?
:জানিনা...
:ধ্যাত! বল তো!
:তোর নুডুলস আমাকে সারাজীবন খাওয়াতে পারবি?
হঠাৎ যেন সব ঝাপসা হয়ে আসল অনন্যার চোখে... কাঁদোকাঁদো হয়ে সে বলে...
:পারব...
:আমার ব্রেকফাস্ট এ...লাঞ্চ এ, বিকালের নাস্তায়,ডিনার এ... পারবি না আমাকে সারাজীবন খাওয়াতে?
:তোর জন্যে আমি সব পারি রে বলদ...
:বেশি না... নুডুলস খাওয়ালেই হবে...
:আচ্ছা...
:আই লাভ ইউ পাগলী!
:ধুর গাধা!!
এভাবেই দূরে কোথায় হারিয়ে গেলো অন্তু-জেবা!! রুদ্র আর অনন্যা একজন আরেকজন এর হয়ে গেলো!!

২০ বছর পর

পার্কে সাতসকালে জগিং করতে এসেছে রুদ্র। একটু পরেই হসপিটালে দৌড় লাগাতে হবে,সারাদিন ডিউটি।কোর্টে অনন্যার একটা কি জানি জটিল কেস চলছে...আজ সকালেই বেরিয়ে গেছে। ডাক্তার স্বামী আর উকিল বউ এর সংসারে অবসর খুব কম। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী সপ্তাহ থেকে টানা ১ মাসের জন্য ইউরোপ ঘুরবে,শুধু নিজেদের মতো করে সময় কাটাতে।

হঠাৎ ট্রাকসুট পরা এক মহিলার দিকে চোখ আটকে গেলো তার। মহিলাটাও এদিকে তাকিয়ে আছে। সকালের প্রথম সূর্য রশ্মি গাছের পাতা ভেদ করে মুখে এসে পড়ল মহিলার...বুকের মাঝে রক্ত চলকে উঠল রুদ্রর!!

জেবা!!! আজ এতদিন পর আবার তার সামনে তার হারানো,বিস্মৃত ভালবাসা! কিন্তু কই? জেবার জন্য ন্যূনতম ভালবাসাও তো হৃদয় হাতড়ে পেলো না রুদ্র?
জেবাও চিনতে পেরে এগিয়ে আসল। "আরে!! রুদ্র না?"
রুদ্র হাসল ' হ্যাঁ!! জেবা? ওরকম আছ দেখি!!'
:কেমন আছ?
:ভাল...তুমি?
:ভালো... এখানেই থাকো? অনন্যার কি খবর?
:ও আজকাল উকিল।আমিও ডাক্তারি করছি। তোমার খবর বল।কি করছ?
:ব্যাংকার। আমার হাজব্যান্ড পাইলট।
:ও! দেখ তো! সেইদিন কার কথা...না?
: সেইদিনকার কোন কথা?- জেবার গলার স্বর তীক্ষ্ণ।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো রুদ্র,
:না মানে...
:বল?কি কথা?
:কিছু না।
:কিছু না? এরকম করলে কেন আমার সাথে?
রুদ্র অবাক!
:কেমন করলাম?
:জাননা? জাননা কেমন করেছ?
:কি বলছ জেবা?
:আমাকে বলেও কেন বল নি তুমি?
এবার রুদ্রর পালা-
:কি বলিনি? অন্তুকে দিয়ে তোমাকে বলিনি?
:হুম!সেটা প্রথমে। তারপর? কি হল তোমার যে আমার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলে?
রুদ্র নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারল না!
:জেবা!! কি বলছ তুমি?আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম? নাকি তোমার আরেকজন এর সাথে সম্পর্ক ছিল?
এবার জেবাও অবাক...
:মানে? যে আমি প্রতিটা মুহূর্ত তোমাকে দিয়েছিলাম...সেই আমার আরেকটা সম্পর্ক থাকবে?
:সত্যি বলছ? সত্যি?
:হুম...কেন? আমার প্রতি কেন তুমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলে?বল?জবাব দাও! চুপ কেন?
:জেবা...বিশ্বাস কর,আমি কখনই এসব অন্তুকে বলিনি!! কখনই না!
:সত্যি? -জেবা অবাক।
:হুম
:তাহলে? কি হয়েছে? কি এমন হল যে আমি তোমাকে পেলাম না?
:জানিনা।
কিছুক্ষণ চুপ থাকলো জেবা।তারপর বলল
:অন্তু আত্মহত্যা করেছিলো।
:হুম
:এখন বুঝনি কেন?
ঝট করে তার দিকে তাকাল রুদ্র! তার চোখে অবিশ্বাস!
:আমার জন্যে?
আস্তে করে মাথা ঝাকাল জেবা..."তোমাকে ভালবেসেছিল ও..."
কিছুক্ষণ অসহনীয় নীরবতা।
:আমি সুখী জেবা।
:আমি জানি।
:ভালবাসা পেয়ে ভালবাসা দেয়ার মাঝে সবথেকে বড় সুখ।
:জানি আমি।
:হুম।
:নিয়তিই আমাদের কে এক হতে দেয় নি।
:হুম
:ভালো থেক।
:থাকব।তুমিও থেকো।
মিষ্টি করে তার সেই ভুবনভুলানো হাসি টা হাসল জেবা।
:চেষ্টা করবো এখন থেকে।
:যাই।
:আচ্ছা।আর শোন!
:বল।
:আমাকে মাঝে মাঝে মনে কোরো।
হাসল রুদ্র...
:করবো।

রুদ্র পিছন ঘুরল। আজ তার মনে একটা প্রশান্তি! তার মনে হচ্ছে, অনন্যা কে এতদিনে সে সত্যিকারের ভালবাসতে পারল...জেবাকে প্রত্যাখ্যাত করে...

সে ভারি একটা শ্বাস নিল। প্রশান্তির শ্বাস!

চলে আসার সময় রুদ্র পিছন ফিরে তাকায় নি। তাকালে দেখতে পেত, কদম গাছটার নিচে বসে, অজস্র ঝরা পাতার মাঝে, জেবার অনিন্দ্যসুন্দর গালে সূর্যরশ্মি এসে পড়েছে...কিন্তু তার সৌন্দর্য ভেদ করে সূর্যরশ্মি তার অশ্রু ভেজা গালকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছে...।

লিখেছেন-নিঃসঙ্গের স্বপ্নযাত্রী

No comments:

Post a Comment