Responsive Ads Here

18 January 2012

পত্রমিতা

একটা ভালোবাসার গল্প

তখন ভরদুপুর । কারেণ্ট টাও গেছে । গরমে সিদ্ধ হয়ে ক্লাসে মনোযোগটা দেয়াটা অসম্ভবের কাছাকাছি । আর সেই ক্লাসটা যদি হয় 'theory of SIMPLE structure ' এর , তবে তো কথাই নেই । কিছুক্ষণ উশখুশ করে সাহিন অবশেষে উঠে দাঁড়ালো ।
স্যার !
কি ব্যপার ? কোন সমস্যা ?
একদম না ।একটু বাথরুমে....
হুমম ।
প্রায় উড়ে বের হলো ডুয়েট এর সিভিল ইন্জিনিয়ারিং এর ল্যাব থেকে । পিছনে তাকিয়ে এলাহী , জাহিদ আর ইউসুফের দিকে শয়তানি মার্কা হাসি দিল সাহিন । ওদের চোখে তখন বিষভরা দৃষ্টি। সন্তর্পনে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এক দৌড়ে হলে চলে গেল । দারোয়ান টা এগিয়ে এলো তাকে দেখে, সাহিন ভাই , একটা চিঠি আসছে । রুমে দিয়ে আসছি ।
নীরবে মাখা ঝাঁকালো সাহিন। কার চিঠি হতে পারে ? দুদিন আগেই আব্বা আসছিল । আব্বা লিখবে না । নিশ্চয়ই কোন মেয়ের চিঠি ! ভাবতেই মনটা উত্‍ফুল্ল হয়ে উঠলো ।

কিছুদিন আগেই চার বন্ধু মিলে গাজীপুরের স্থানীয় ম্যাগাজিনে 'পত্রমিতা চাই' নামে একটা চিঠি লিখেছিলো । অসংখ্য চিঠি আসছে । অধিকাংশই মেয়ে । হলের কিছু ছেলে ও বান্দরামি করে চিঠি পাঠিয়েছে । সুন্দর চিঠি গুলো বেছে চার জন ভাগ করে নেয় ।

সত্যিই এক মেয়ের চিঠি । নাম সুরভী । চিঠির ভাষা দেখে থমকে যায় সাহিন । এত আবেগ একটা মেয়ের মনে কেমন করে থাকে ? একটা চিঠি না যেন ! একটা শিল্পীর অপূর্ব এক চিত্রকর্ম । সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সাহিন । এ চিঠি আর কাউকে দেবে না । কাউকে দেখতেও দেবে না । এটা শুধুই তার !
বাইরের কড়ারোদ আর কারেন্ট নেই । অখচ চিঠিটা বুকপকেটে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সাহিন । শান্তির ঘুম ।

সাহিন কেমন বদলে যাচ্ছে । এই বদলে যাওয়াটা চোখে পড়ে সবার । ক্লাসশেষে চায়ের আড্ডাটা সাহিন ছাড়া একদম জমেনা ।

'কিছু তো একটা হইছে । বাইর করতে হইবো । ' -সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে এলাহী ।
শালা প্রেমে পড়ছে নাকি ! চিঠি আসলে নেয় না । আগের গুলাও ফেরত দিছে । মাইয়া গুলাও সাহিনরে খুঁজে । কাহিনী কি ? - বলতে বলতে চায়ের কাপে চুমুক দেয় জাহিদ ।
চল , ধরি গিয়া । না কইয়া যাইবো কই ? - ইউসুফ পাশ থেকে তাগাদা দেয় ।
দ্রুত বলে উঠে এলাহী , থাক না । নিজেই বলবেনে । জোর দিসনা ।
সাহিনের পড়াশোনায় অমনোযোগিতা নজর এড়ায়নি তার । সব পরীক্ষায় সে সেকেণ্ড হয় ঠিকই কিন্তু সাহিন তার থেকে এক দেড়শ নাম্বার বেশি পেয়ে ফার্স্ট হয়ে যায় । এবার যদি ....

ইউসুফ খবর বের করেই ছাড়লো । গল্পের নায়িকা সুরভী । ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়া এক অষ্টাদশী । অডনেন্সের সিকিউরিটি অফিসারের মেয়ে । পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে ই । ভাল ছাত্র হিসেবে যেমন সাহিন সর্বজনবিদিত তেমনি ফাযিল আর দুষ্ট হিসেবেও তার খ্যাতি ছিলো শহরজোড়া ।
সেদিনের চা সিগারেটের সব খরচ সাহিনকে দিতে বাধ্য করা হয় ।

সাহিন সুরভীর চিঠি চালাচালি বন্ধুত্বেই সীমাবদ্ধ ছিলো । প্রেমের কোন সম্পর্কই ছিলো না তাতে। সাহিনের মনের খবর সুরভির কাছে পৌছত না । সুরভির দেয়া ঠিকানায় গিয়েও ঘুরে এসেছে সে। সুরভীও কম চালাক না । বান্ধবীর ঠিকানায় চিঠি আদান প্রদান করতো । নিজে গিয়ে সাহিন কে দেখে এলেও কিছুতেই দেখা দিতে চায়না সে । যতই আড়ালে থাকতে চায় সুরভী ততই তৃষ্ণা বাড়ে সাহিনের ।

কোন এক আষাঢ়ের সন্ধ্যাবেলা । ক্লাস সিক্সের লিপিকে পড়াতে গেলো সাহিন । তখনো জানতো না তার সমস্যার সমাধান এই মেয়েটাই করে দিবে ।
পড়াতে পড়াতে যখন অন্যমনষ্ক হয়ে উঠলো সাহিন , হঠাত্‍ মুখ ফুটে বলে ফেললো মেয়েটা ,
সুরভি আপুর কথা ভাবছেন ??
চমকে উঠলো সাহিন । এই মেয়েটা কি থটরিডার নাকি ?
আমি জানি , আপনি ই সুরভী আপুর বন্ধু ।
তুমি চিনো সুরভীকে ?
চিনবো না কেনো ? আমার বড় আপুর বান্ধবী তো । কাল ওরা আপনার কথা বলছিলো । আমি শুনেই বুঝেছিলাম ।
ওদের বাসার ঠিকানা দিতে পারবে ? - হঠাত্‍ উত্তেজিত হয়ে উঠে সাহিন ।
না ভাইয়া । তবে আমার কাছে ছবি আছে । দেখবেন ?

হাতে যেনো আকাশের চাঁদ পেলো সাহিন । দুচোখ ভরে দেখছিলো সে ।
ছবিটা আমি নেই ??
না ভাইয়া । এটা আপুদের কলেজের স্টাডি ট্যুরের একটা মাত্র ছবি ।

পরদিনই তিন বন্ধুকে নিয়ে আজিমুদ্দীন কলেজ গেটে হাজির হয়ে যায় সাহিন । তার নায়িকার সন্ধানে । সুরভী কিংবা বৃষ্টি । তৃতীয় চিঠি থেকেই বৃষ্টি নামেই ডাকতে শুরু করে সুরভীকে । সুরভীও প্রিয় মানুষটার দেয়া নামটা আপন করে নেয় । সাহিনের ও নতুন নামকরণ হয় । নদী । বৃষ্টি বুকে বরণ করতে মোটেও আপত্তি করেনি নদী ।
লিপির কাছ থেকে সুরভীর ছবিটা চুরি করতে মাত্র একদিন লেগেছিলো সাহিনের । হঠাত্‍ এলাহী লাফিয়ে উঠলো ,
ঐ যে তোর বৃষ্টি ! রিক্সায় উঠলো !
পড়িমড়ি করে রিক্সার পেছনে ছুটলো সাহিন ।
লক্ষ্যই করলো না তার প্রিয় মানুষটা একটু দূর থেকে পুরো ব্যপারটাই খেয়াল করলো ।

বছর পেরুতে লাগলো । ডুয়েট থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে বের হলো সাহিন । সেই বছর পুরো বাংলাদেশে সিভিল ইন্জিনিয়ারিং এ ফার্স্ট হয়ে রাজকীয় ভাবে গোল্ড মেডেলটা বাগালো সাহিন ।সুরভিও ঢাকা ইউনিভার্সিটির বোটানিতে চান্স পেলো । কিন্তু এই ঘাস , লতা , পাতা ছিলো সাহিনের দুচোখের বিষ । তাই ইডেনে ভর্তি হলো সাহিনের ইচ্ছানুযায়ী ।
আর দেরী না করে সাহিন সুরভীর মেঝভাইকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় । সাহিনকে "বাসায় কথা বলে দেখি " বলে ছুটে বাসায় যান তিনি । যত ভালো ছাত্রই হোক এ ছেলের হাতে মেয়ে দেয়া যায় না । তথনি একটা বিয়ের প্রস্তাব চলে আসে সুরভীর । সানন্দে তাতে মত দেয় সকলে । পরিবারের অমতে যাবার ক্ষমতাটুক ও নেই সুরভীর । তাই নিজেকে আড়াল করে বিয়েতে রাজি হয় । ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে বিয়ের দিন ।
এসবকিছুই ঘটে যায় সাহিনের আড়ালে । ততদিনে ঢাকা ওয়াসাতে নতুন চাকরী নিয়ে ব্যস্ত সাহিন । যখন সুরভীর শেষ চিঠিটা হাতে পৌঁছায় তখন ১৬ তারিখ । পরদিন ১৭ই জানুয়ারী । সুরভীর বিয়ে ।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে সাহিনের । জীবনটা হঠাত্‍ ফ্যাকাশে হয়ে যায় ।

কোনদিন সুরভীকে ভালোবাসার কথা বলেনি সাহিন । চোখের ভাষাই যখেষ্ট ছিলো । বন্ধুত্বের আড়ালে ভালোবাসাকে ঢেকে রেখেছিলো সে । তবেকি সুরভী শুধুই বন্ধু ভেবেছিলো !

সাহিনের উদ্দামতা কে বখাটেপনা ভেবেছে অনেক মা বাবাই । কিন্তু সত্যিকার অর্থেই বখাটে হয়ে উঠলো সাহিন । বড় ভাই আর কজন বন্ধু মিলে নীরব হামলা চালালো সুরভির বিয়ের আসরে । সবার চোখের সামনে তুলে নিয়ে গেলো সুরভিকে । সুরভীর নীরব সম্মতিই যথেষ্ট সাহস দিলো তাকে । ১৭ই জানুয়ারী তে ই বিয়ে হলো সুরভীর । তবে অন্য কারো সাথে নয় , সাহিনের সাখেই ।
বিয়ের পর হলো আরেক নাটক । সাহিনের বাবা আর সত্‍মা নববধূ সহ সাহিনকে ঘর থেকে বের করে দিলেন । এ দ্বার ও দ্বার ঘুরে কাটল তাদের বিয়ের প্রথম রাত । কোন বাসর সাজল না কোথাও ।

১৭ই জানুয়ারী , ১৯৯২

প্রথম বিবাহ বার্ষিকী । বিয়ের ঠিক এক বছর পর বাসর সাজলো তাদের ।
ফুল আর রঙ বেরঙের কাগজে সাজানো হলো তাদের প্রথম বাসর । যে বাসরে তারা তিনজন ছিলো ! সাহিন সুরভী আর সুরভী গর্ভে গুটিশুটি মেরে পড়ে থাকা ছোট একটা বাচ্চা ।
একটা মাত্র ঢাকা ওয়াসার চাকরী । তাতেই চলছিলো সব । সাহিন বুয়েটে এম এস করছে , সুরভী পড়ছে ইডেনে । সাহিনের ছোট ভাই তনু ঢাকা কলেজে। মাখার উপর একটা ছাদ ছিলো ।এই থাকার ঘর । ঠিকমত খাওয়া হতো না , তবু সুখী ছিলো তারা । বৃষ্টি নদী দুজন মিলে । জুনের ১১ তারিখ । মাত্র আট মাস মায়ের পেটে ছিলো বাচ্চাটা । তারপর অস্থির হয়ে গেলো মা বাবাকে দেখার জন্য । তাই ডাক্তারের দেয়া ডেটের এক মাস আগেই পৃথিবীতে চলে এলো মেয়েটা । হাসপাতালে নেয়ার ও সময় হলো না । আট ইঞ্চি লম্বা একটা বাচ্চা মেয়ে কোলে নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো সাহিন । এটা তার মেয়ে !তার নিজের !
ভালোবাসার "বৃষ্টি" নামটা দুজন মিলে দিয়ে দেয় তাদের মেয়েটাকে । এগিয়ে চলে তাদের ভালোবাসার গল্প ।

আমিই সেই বৃষ্টি । সেই ছোট্ট মেয়েটা আজকে অনেক বড় । আজকে আরেক ১৭ই জানুয়ারী । আমার লক্ষী মামনি আর দুষ্ট বাপির আজ ২১তম বিবাহবার্ষিকী । আজ আমি সাজিয়ে দিবো তাদের দ্বিতীয় বাসর !
আল্লাহ , তুমি ওদেরকে ভালো রেখো । আর বুঝিয়ে দিয়ো আমি অনেক দুষ্টামী করি ঠিকই কিন্তু মামনি বাপীকে অনেক বেশী ভালবাসি !

লিখেছেন-ANIKA TABASSUM BRISTY

No comments:

Post a Comment