Responsive Ads Here

19 January 2012

বাচ্চা ভুত

মানুষের ছোট ছেলেপুলেদের আমরা বাচ্চা বলে থাকি। ভূতদের মধ্যেও বাচ্চা ভূতেরা রয়েছ,তারা সুযোগ সুবিধা পেলে নানা কান্ডকারখানা করে। আর ভূত তো-ইচ্ছা করলে কখন-সখন তুলকালাম কান্ডও করতে পারে। ঘোষবাবুর ছেলে গবু দু’বার ক্লাশ ফাইভে ফেল করল। অংকতে শূ্ন্য, ইংরেজীতে সাত, এমনি তার পরীক্ষার নম্বর- অথচ রেজাল্ট বেরুবার দিন এবার গবু দিব্যি সেজেগুজেই ইসকুলে হাজির হয়েছিল। ইসকুলে যাওয়ার পথে গম্ভীরা সাধুবাবার পায়ের কাছে টাকাও রেখেছিল। গম্ভীরাবাবা তান্ত্রিক সাধু, গবুর ভক্তি লক্ষ্য করে তিনি অত্যন্ত প্রীত হয়ে গবুর কপালে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে আশীর্বাদও করলেন। গম্ভীরাবাবা কথা বলেন না, সর্বদা গম্ভীর হয়ে থাকেন। তাঁরচেলা ফটকরামই গম্ভীরাবাবার পায়ের কাছে টাকা পয়সা পড়লে টক করে তুলে ট্যাকে গোঁজে।ফল-ফলাদি পড়লে তুলে নিয়ে আশ্রমের ভাঁড়ার ঘরে রেখে আসে। এটাই নিয়ম এবং এই নিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চালু আছে। গবু তাই ফটকরামকে জিঞ্জাসা করল, সাধুবাবা তো আর্শীর্বাদ করলেন, এবার পাশ করবো চেলাজী?
- জরুর- বাবা যখন তোমার মাথায় টিপ টিপ পরিয়ে দিয়েছে তখন তোমায় আটকায় কে ? ফাস্ট সেকেন্ডও হয়ে যেতে পারো।
- বলেন কি চেলাজী ?
- ঠিকই বলছি, বাবার আর্শীর্বাদ পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়, বাচ্চা !
অতএব গবু বেশ আন্দের সাথেই ইস্কুলে গেল। গবুর বন্ধু তোন বলল, গবু, এবার পাশ করতে পারবি তো ? গবু হেসে বলল, শুধু পাশ নয়রে, এবার সকল কে চমকে দিয়ে এক থেকে দশের মধ্যেও চলে আসতে পারি।
- বলিস কী রে ?
- ঠিকই বলছি।
তোতন বলল, আমি বোধ হয় ফেল করে যাবোরে, আর ফেল করলেই বড়দা আমায় মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। গবু বলল, ভাগ্যিস আমি গম্ভীরাবাবার আশীর্বাদ নিয়ে এসেছি- নইলে এবারও ফেল করলে- আমায় বড়দা, মেজদা তো বেদম মারতোই, বাবা পর্যন্ত ধাক্কা দিয়ে বের করে দিত।
- তুই আগে বললি নে কেন ? আমিও গম্ভীরাবাবার আশীর্বাদ নিয়ে আসতাম।
- তোকে একথাটা বলার কথা মনে আসেনি। নইলে ঠিকই বলতাম।কিছু মনে করিসনে ভাই।
কিন্ত প্রথম লিস্ট বেরুতেই গবুর নাম খুজেঁ পাওয়াগেল না। দ্বিতীয় লিস্টেও গবুর নাম নেই, কিন্ত তোতনের নাম শেষের দিকে রয়েছে।
তোন হাসতে হাসতে বলেল, তোর নাম যে কোন লিস্টেই নেইরে গবু।
গবু গোঁ গোঁ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
তোতন আর ঘোতন জল-টল ঢেলে কোন রকমে গবুর জ্ঞানফিরিয়ে আনল।কিন্তু মূর্ছা ভঙ্গ হলেও গবু রেহাই পেলনা, পিয়ন এসে বলল,- এইযে গবুবাবা, আপনাকে আকবার এখুনি হেডস্যার দেখা করতে বলেছেন।
অতএব গবু প্রায় কাঁপতে কাঁপতে হেডস্যারের ঘরে হাজির হলো। হেডস্যার হাতে গবুর প্রোগ্রেস রিপোর্ট খানা ধরা ছিল, তিনি বলেলন, গবু, তুমি কোন্ বিষয়ে কতো পেয়েছ- তোমার জানা দরকার। আমি এক এক করে তোমার বিভিন্ন বিষয়ের প্রাপ্তনম্বর গুলো বলে যাচ্ছি।
গবু মাধা নিচুকরে রইল।
হেডস্যার বলতে লাগলেন, অংকতে শূন্য, ইংরেজীতে সাত, ভূগোলে আঠ, ইতিহাসে নয় এবং বাংলায় তেরো।--- এই প্রগ্রেস রিপোর্ট বাড়ী গিয়ে তোমার বাবাকে দেখাবে- আর বলবে আগামী বছরো ফেল করলে- তোমার মতো এমন রত্নকে আর আমাদের ইসকুলে রাখা হবে না। এই প্রোগ্রেস রিপোর্টটা সঙ্গে নাও, অবশ্য একে প্রোগ্রেস রিপোর্ট না বলে ডিগ্রেডেশান রিপোর্ট বলাই ভালো।
গবু হাত পেতে প্রোগ্রেস রিপোর্টটা সঙ্গে নিল, তারপরই কোন কথা না বলে হেডস্যারের রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এল।
ইসকুল থেকে বাইরে বেরিয়েই পাকা পীচঢালা পথ দিয়ে সে চলতে লাগল, অবশ্য বাড়ীর দিকে নয়- উল্টো দিকের পথে, অর্থ্যৎ অজানা পথে।
বাড়ী ফেরার কথা গবু ভাবতেও পারল না, কারণ বাড়ী ফিরলেই বড়দা আর মেজদা প্রোগ্রেস রিপোর্ট চাইব্, বকবে, তারপর ঝড়ের বেগে বকবে, তারপর ঝড়ের বেগে কিল চড় লাথি মারবে দমাদম। তারপর যে কি হবে, সে-কথা ভেবেই সে শিউরে উঠতে লাগল।
অতএব বাড়ী যাওয়ার কথা সে ভাবতেই পারল না, উল্টো পথ ধরল।
বেশ কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর পথে চুন্নু মিঞার সঙ্গে দেখা। চুন্নু মিঞার গবুদের বাড়ির বারই পরিচিত, কারণ মাঝে মাঝেই হাসের ডিম, মুরগীর ডিম ইত্যাদি নিয়ে গবুদের বাড়ী যায়।
গবুকে দেখতে য়ে চুন্নু মিঞা জিজ্ঞাস করল, একি গবুবাবু ইদিকে কোথায় চললেন?
গবুর মন মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল, চুন্নু মিঞার মতন কোনো চেনা লোকের সঙ্গে যে তার দেখ হবে, তা সে ভাবতেই পারেনি। সে বিরক্ত হয়ে বলল, জাহান্নামে যাচ্ছি।
-জাহান্নামে ? হাজান্নামে বলে কোন গাঁ তো ইদিকে নেই, আপনি ভূল পথে আসছেন, আর যিদিকেই যাননা কেন বাবু জাহানপুর বিলের কাছে কখোনও ভরদুপুরে আর সন্ধ্যেবেলায বেড়াতে যাবেন না।
- কেন ?
- জাহানপুর বিলের কাছের গাছগুলিতে বলতে গেলে ছোট-বড়ো নানান ভূতদের আড্ডাখানা। ভূতেরা একবারে গিজগিজ করে শিখানটাতে!
- সেই জাহানপুর বিলটা কোথায় ?
- সোজা এগিয়ে তারপর পাকা রাস্তা থেকে ডান দিকে মেঠো পথ ধরে ক্রোশ খানেক পথ গেলেই জাহানপুর বিল। ভুলেও ওদিকে যাবেন না গবুবাবু, জেলেরা পযর্ন্ত মাছ ধরেতে ওদিকে যায়না- যেতে ভয় পায়।
- কেন?
- যে জেলে জাহানপুর বিলেতে একরার মাছ ধরতে গেছে সে আর ফিরে আসেনি। আমরা দিনের বেলাতেও ওদিকে যাইনা।
- ঠিক আছে। আমি এদিকে সোজাসুজি একবালপুর যাব, ওখান থেকে বাসে চড়ে মামাবাড়ি ঘসেটি যাব।
- তা এই অসময়ে মামাবাড়ি যাবেন কেনে? ইবারেও বুঝি পরীক্ষাতে ফেল করেছেন ?
গবু গম্ভীর হয়ে বলল, তা নয়, একটা বিশেষ দরকারে মামার বাড়ি যাচ্ছি।
গবু কিন্ত একবালপুবে গেলনা, আর মামার বাড়িতেও যাবে না, করণ গতবার সে ফেল করার পর মামাবাড়িতে গিয়েছিল, মেজদা পরের মাসেই মামাবাড়ি গিয়ে তাকে কান ধরে টানতে টানতে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছিল। চুড়ান্ত অপমানিত হয়েছিল গবু।
সেই থেকে মামা-মামীর কাছে মুখ দেখানোর কোনো উপায় গবুর নেই। বরং মামাতো ভাই গবুকে এসময়ে মামা বাড়িতে দেখলে হাসাহাসি করবে। বলবে, ওরে গবু আবার বুঝি ফেল করেছিস ?
অতএব আমার বাড়ি যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা, মামাবাড়ী বড়দা বা মেজদার নাগালের বাইরে নয় মোটেই।
মনে মনে গবু ঠিক করে ফেলল, সে জাহানপুরের বিলেই যাবে, ভূতদের মুখোমুখি হবে, ভূতেরা যদি তার ঘাড় মটকে দেয় - তবে আর কোন ভাবনাই ধাকে না। বড়দা, মেজদা মারার সুযোগ পাবে না, বকতেও পারবে না, - এমনকি উগ্র মেজাজী বাবার খপ্পরেও পড়তে হবে না তাকে আর।
অতএব সে কিছুটা এগিয়ে জাহানপুরের বিলের পথই ধরল।পথে একটাও জনমণিষ্যি নেই- গাছগুলোর দিকে তাকালেই গা ছমছম করে ওঠে।
একটু এগুতেই কারা যেন খিলখিল করে হেসে উঠল।
গবু চিৎকার করে উঠল, কে হাসে ? কে হাসে ? জবাব দাও।
কিন্তু করো কাছ থেকে কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না, অর্থ্যাৎ কেউ জবাব দিলনা। আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই একটা পেঁচা বিশ্রীভাবে ডেকে উঠল।
গবু আর কোথায় যাবে? আ বেশি দূর এগুবার বোধহয় প্রয়োজনও ছিলনা- কারণ সামনেই জাহানপুরের বিল- বিলের জল টল্ টল্ করছে।দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে দু’একটা বড় মাছ মাথা তুলে যাই মারছে।
গবু আর একটু এগিয়ে বিলের প্রায় কাছাকাছি একটা চালতা গাছতলায় বসল। ওখানথেকে সে দেখতে পেল দু’একটা বেশ বড় মাছ মাথা তুলে তাকিয়ে, আবার ভুস করে বিলের জলে ডুব মারছে। আবার মখি তলে তাকাচ্ছে।, আবার ডুব মারছে।
গবু ভাবল মাছগুলো হয়তোবা সাধারণ মাছ নয়, ওগুলো নিশ্চই মেছো ভূত। মানুষ যেমন অপঘাতে মরে গিলে ভূত হয়, তেমনি হয়তোবা মাছেরা অপঘাতে মরে গিয়ে মেছো ভূত হয়ে থাকে। মানুষ অপঘাতে মরলে যে সচরাচর ভূত হয়, একথা গবু দিদার কাছে শুনেছে। অপঘাতে মরা মানে আত্মহত্যা করে মরা বা দুর্ঘটনায় মরা। ঐ ভাবে অপঘাতে মরার পর যদি তার বংশের কেউ গয়ায় পিন্ডি না দেয়- তবে তারা নকি ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
আর মাছেরা তো সবসময়ই অপঘাতে মারা যাচ্ছে।, তাদের হয়ে কেউতো আর গয়ায় পিন্ডি দিতে যায় না। তাইতো মেছো ভূতেরা এসে জাহানপুরের বিলে জমা হয়েছে।
মাছদের গোত্তরই হয় না, আর গোত্তর না জানা থাকলে গয়ায় গিয়ে পিন্ডি দিয়ে কোন লাভ হয়না। অবশ্য মাছদের গোত্তর থাকতে পারে তা মানুষের পক্ষে অজানা, মাছদের গোত্তর মাছেরাই কেবল জানে, কিন্তু মাছদের বংশের করো পক্ষেই তো আর গয়ায় যাওয়া সম্ভব নয় রেলে চেপে। তাই ওদের মেছো ভূত হয়েই জাহানপুরের বিলে চিরটা কাল থাকেত হবে।
এসব অবশ্য গবু মনে মনে ভাবল। আরও ভাবল- ওগুলো যদি মেছো ভূত না হ’তো তবে জেলেরা নিশ্চই জাহানপুরের বিলেও হানা দিত। ইতিমধ্যে আবার একটা মাছ মাথা তুলে বেশ কিছুক্ষণ গবুর দিকে পিট পিট করে তাকিয়ে আবার জলের ডুব দিল।
গবু ভাবল আবার কোন মেছো ভূতজল থেকে মাথা তুলে তার দিকে তাকালে, সে এবার স্পষ্টই জিজ্ঞাস করবে।
আর একটা বিরাট মাছ জল থেকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে তুলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতেই গবু চট্ করে জিজ্ঞাস করল, আপনি কি মেছো ভূত নাকি ? মাছটাও চটপট জবাব দিল, আজ্ঞে হাঁ।
- আচ্ছা, এ বিলে আপনার মতো কটা মেছো-ভূত রয়েছে?
- তা দশ বারোটা তো হবেই।
- এই বিলেতে অনেক মাছ, তা জেলেরা এখানে মাছ ধরতে আসেনা কেন?
- আমরা যে দশ-বারো জন মোছো ভূত এখানে রয়েছি, আমাদের ভয়েই কোন জেলেই এ বিলে মাছ ধরতে আসেনা।
- কোন?
- আমরা জেলেদের জাল ছিঁড়ে দিই, লেজের ঝাপটা মেরে জেলেদেরজলে ফেলে দেই, যাকে ঝাপটা মেরে জলে ফেলে দি, সে আর এ জীবনে ওপরে উঠতে পারে না। জলেই ডুবে মরে সে।
- কেন? জল কি খুব গভীর নাকি? না, এই বিলে কুমির আছে?
- না- জলও গভীর নেই আর কুমীরও নেই।
- তবে?
- মেছো-ভূতের জাপটা খেয়ে কেউকি আর বাঁচে?
- কিন্তু ভাই, আমার যে জলে ডুবে মরতে খুব ভয় করে!
- এইটুকু তো তোমার বয়স, এই বয়েসে মরবে কেন?
- মরতে চাই কি আর সাধে, মেছো-ভূতদা? আমার যে বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই।
- কেন?
- দুবার এ্যানুয়াল পরীক্ষায় ফেল করলাম, বাড়িতে গেলে বড়দা পেটাবে, মেজদা পেটাবে, বাবারও উগ্র মেজাজ, তাই আমার বেচেঁ থাকার কোন ইচ্ছেই নেই।
- তা এখানে এলে কেন?
- মরতে!
- এখানকার খবর কার কাছ থেকে পেলে?
- আমাদের বাড়িতে যে চুন্নু মিঞা ডিম বেঁচে যায়, তার কাছেই শুনলাম জাহানপুরের বিলের কাছের গাছ-গাছালিতে কেবল ভূতের আড্ডা। ভূতেরা যদি বাগে পেয়ে ঘাড় মটকে মেরে ফেলে আমার খুব ভাল হয়। আর বাড়িও ফিরতে হয় না, আর আমায় কেউ মারতে কিংবা বকতেও পারবেনা, আর ফেলটু বলে কাথায় কথায় অপমানও সইতে হবেনা। আমি চাই ভূতেরা এসে আমায় গাড় মটকে মেরে ফেলুক। আমার বাঁচার ইচ্ছে নেই।
- তা বাছা, সারা বছর মন দিয়ে পড়লেই পারতে, ফেলও করতে না- আর বাবর বকুনি কিংবা অপমানিত হওয়ারও কারণ থাকত না।
- সে চেষ্টা কি আর করিনি মেছো ভূতদা? কিন্তু আমার মাথয় যে কিছু ঢোকেনা, সবাই বলেআমার মাথায় গোবর পোরা রয়েছ। আমি য পড়ি;- কিছই মনে রাখতে পারিনা। পরীক্ষার খাতায় লেখার সময় সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়- খেই হারিয়ে ফেলি একদম।
- দেখি, ভেঁপু-টেঁপু ফিরে আসুক তোমার খুব ভালো ব্যবস্থা করে দেবো।
- ভেঁপু-টেঁপু কে?
- দুটি বাচ্চা ভূত, তুমি যে চালতা গাছটার নীচে বসে রয়েছ ওরা ওই গাছের ওপরে থাকে।
- ওরা এখন কোথায়?
- বাচ্চা ভূততো, ভয়ানক দুষ্টুও বটে, এদিক-ওদিক বেড়াতে গেছে নিশ্চয়ই।
- ওরা এসেই কি আমার ঘাড় মটকে দেবে?
- আরে না-না। ওরা খুব ভাল ভূত, কখনও কারও ঘাড় মটকায়না বা কারো ক্ষতি করে না, তবে মাঝে মাঝে সামান্য একটু দুষ্টামি করে। গবু হতাশ হয়ে বলল, ওরা যদি আমার ঘাড় মটকে না মেরে ফেলে, তবে আর আমার লাভ কী? সেইতো বাড়ি ফিরে যেতে হবে, বড়দা, মেজদা ও বাবার কত অপমান হবে। তাছাড়া ফেলটু হিসাবে চারিদিকে কত অপমান, আত্নীয়-স্বজনেরা আমায় দেখে ছ্যা-ছ্যা করে বলবে:
ঐ তোরে ফেলটুরাম
মাথায় গোবর ভরা;
সারাদিন বেড়ায় ঘুরে
নেইকো লেখাপড়া
তুমিই বলো মেছো-ভূতদা, এসব শুনে কি আর কারো বেচেঁ থাকতে ইচ্ছে করে? তা যাও বা কিছু হোত, বড়দা আর মেজদা বারবার আমার মাথায় চাঁটি মেরে মেরে মাথার ঘিলুই নাড়িলে দিয়েছে, আমার আর কিছু হবে না। কিছু হওয়ার আশাও নেই।
- হতাশ হয়ো না ভাই। ভেঁপু-টেঁপু আসুক তোমার একটা ভালো ব্যবস্থা হবেই- ভেঁপু-টেঁপু ইচ্ছে করলে তোমায় সবার সেরা ছাত্র বানিয়ে দিতে পারে- ওদের অসাধ্য কিছু নেই।
- ভেঁপু-টেঁপু আসার সময় হয়ে গেল, এই এল বলে।
- আমার যে প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে মেছো-ভূতদা?
- ঠিক আছে ভেঁপু-টেঁপু আসুক- তোমার খাওয়ার ব্যবস্থাও করা যাবে।
কিছু পরেই ভেঁপু-টেঁপু নামেদুই বাচ্চাভূত এল, বলতে গেলে একবারেই শিশু। মানুষের তিন-চার বছর বয়সের বাচ্চ্রা যেমন হয়,ঠিক তেমনি। সারা গাখালি, পরনে জঙিয়া। দু’জনের জঙিয়াই লাল রংয়ের।
গবুকে তাদেরই চালতা গাছতলায় দেখতে পেয়ে ভেঁপু-টেঁপুকে জিজ্ঞাসা করল,
- ইনি আবার কিনিরে?
- কোথা থেকে এলেন?
- এলেন তো এলেন বটে-
- ইখানেতেই বসলেন!
সে কথাশুনে -টেঁপু বলল, বারে, আমিই বা জানব কি করে? তুই খোনে গিয়েছিলি, আমিও সেখানে গিয়েছিলাম, আর একই সঙ্গে ফিরে এলাম। আমরা যখন ছিলাম না তখন এসে গাছতলায় জুড়ে বসেছেন।
ভেঁপু গবুকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে হে?
- গবু।
- গবু তো বুঝলাম, নিশ্চয়ই মানুষের ছেলে- তা এখানে মরথে এলে কেন? এখানে কি মানুষ আসে?
এমন সময় জল থেকে সেই বড়ো মেছো ভূতটা মাথা তুলে বলল, ওরে ভাই ভেঁপুরে, ওরে ভাই টেঁপুরে -
- ভেঁপু জিজ্ঞাসা করল , কী ব্যাপার মেছোদা?
- তোদের পরনে আবার জাঙ্গিয়া কেন রে?
- মানুষের পাড়ায় এই দুপুর বেলা বেড়াতে গিয়েছিলাম তো, তাই নেংটো হয়ে যেতে লজ্জা করল মেছোদা, তাই জাঙ্গিয়া পরে গিয়েছিলাম।
- ভূতের আবার লজ্জা!
- কী যে বল মেছোদা, ভূত হলেও আমাদের লজ্জা, ঘেন্না যথেষ্ট আছে, বরং এখনকার মানুষদের ওসব বালাই নেই।এমনকি দয়া-মায়াও নেই।কিন্তু এদিকে একজন মানুষের বাচ্চা এসে আমাদের গাছতলায় গ্যাঁট হয়ে বসে রয়েছে, দেখেছ মেছোদা।এসব অবশ্য গবু মনে মনে ভাবল। আরও ভাবল- ওগুলো যদি মেছো ভূত না হ’তো তবে জেলেরা নিশ্চই জাহানপুরের বিলেও হানা দিত। ইতিমধ্যে আবার একটা মাছ মাথা তুলে বেশ কিছুক্ষণ গবুর দিকে পিট পিট করে তাকিয়ে আবার জলের ডুব দিল।
গবু ভাবল আবার কোন মেছো ভূতজল থেকে মাথা তুলে তার দিকে তাকালে, সে এবার স্পষ্টই জিজ্ঞাস করবে।
আর একটা বিরাট মাছ জল থেকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে তুলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতেই গবু চট্ করে জিজ্ঞাস করল, আপনি কি মেছো ভূত নাকি ? মাছটাও চটপট জবাব দিল, আজ্ঞে হাঁ।
- আচ্ছা, এ বিলে আপনার মতো কটা মেছো-ভূত রয়েছে?
- তা দশ বারোটা তো হবেই।
- এই বিলেতে অনেক মাছ, তা জেলেরা এখানে মাছ ধরতে আসেনা কেন?
- আমরা যে দশ-বারো জন মোছো ভূত এখানে রয়েছি, আমাদের ভয়েই কোন জেলেই এ বিলে মাছ ধরতে আসেনা।
- কোন?
- আমরা জেলেদের জাল ছিঁড়ে দিই, লেজের ঝাপটা মেরে জেলেদেরজলে ফেলে দেই, যাকে ঝাপটা মেরে জলে ফেলে দি, সে আর এ জীবনে ওপরে উঠতে পারে না। জলেই ডুবে মরে সে।
- কেন? জল কি খুব গভীর নাকি? না, এই বিলে কুমির আছে?
- না- জলও গভীর নেই আর কুমীরও নেই।
- তবে?
- মেছো-ভূতের জাপটা খেয়ে কেউকি আর বাঁচে?
- কিন্তু ভাই, আমার যে জলে ডুবে মরতে খুব ভয় করে!
- এইটুকু তো তোমার বয়স, এই বয়েসে মরবে কেন?
- মরতে চাই কি আর সাধে, মেছো-ভূতদা? আমার যে বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই।
- কেন?
- দুবার এ্যানুয়াল পরীক্ষায় ফেল করলাম, বাড়িতে গেলে বড়দা পেটাবে, মেজদা পেটাবে, বাবারও উগ্র মেজাজ, তাই আমার বেচেঁ থাকার কোন ইচ্ছেই নেই।
- তা এখানে এলে কেন?
- মরতে!
- এখানকার খবর কার কাছ থেকে পেলে?
- আমাদের বাড়িতে যে চুন্নু মিঞা ডিম বেঁচে যায়, তার কাছেই শুনলাম জাহানপুরের বিলের কাছের গাছ-গাছালিতে কেবল ভূতের আড্ডা। ভূতেরা যদি বাগে পেয়ে ঘাড় মটকে মেরে ফেলে আমার খুব ভাল হয়। আর বাড়িও ফিরতে হয় না, আর আমায় কেউ মারতে কিংবা বকতেও পারবেনা, আর ফেলটু বলে কাথায় কথায় অপমানও সইতে হবেনা। আমি চাই ভূতেরা এসে আমায় গাড় মটকে মেরে ফেলুক। আমার বাঁচার ইচ্ছে নেই।
- তা বাছা, সারা বছর মন দিয়ে পড়লেই পারতে, ফেলও করতে না- আর বাবর বকুনি কিংবা অপমানিত হওয়ারও কারণ থাকত না।
- সে চেষ্টা কি আর করিনি মেছো ভূতদা? কিন্তু আমার মাথয় যে কিছু ঢোকেনা, সবাই বলেআমার মাথায় গোবর পোরা রয়েছ। আমি য পড়ি;- কিছই মনে রাখতে পারিনা। পরীক্ষার খাতায় লেখার সময় সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়- খেই হারিয়ে ফেলি একদম।
- দেখি, ভেঁপু-টেঁপু ফিরে আসুক তোমার খুব ভালো ব্যবসা ।

No comments:

Post a Comment