হিলি রেল জংশন; অমিত বসে আছে ৪ নং কম্পার্টমেন্টে, দিনাজপুর থেকে ঢাকাগামী মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেন আসতে এখনো ১ ঘণ্টার মতো বাকি। রাত প্রায় তখন ১১ তার মতো বাজে। কিছুক্ষণ বসে থেকে পরে পায়চারি করছিলো আর পরিষ্কার আকাশে তারা দেখছিল। অপেক্ষা জিনিশ টা একদমই পছন্দ নয় অমিতের, অমিতের মতে অপেক্ষার মত যন্ত্রণাদায়ক আর কিছু নেই এই দুনিয়ায়! পায়চারি করতে করতে ভাবলো পকেটে এম্পি থ্রি প্লায়ারে গান শোনা যাক। কম্পার্টমেন্টের এক কর্নারে দাড়িয়ে হেডফোন কানে চাপালো অমিত।
পুর্নিমারই রাত্রি জাগা, চাঁদেরই সেই মিষ্টি আভা ভুলো মনে চায় সে আজো তোমায় ভোরেরই মৃদু হাওয়ায়...
চোখ বন্ধ করে গানটা শুনছিল অমিত। গান টা শেষ হতেই যখন চোখ খুলল কম্পার্টমেন্টের অপর দিকে চোখ পড়তেই অমিত দেখল এক সুদর্শনা দাড়িয়ে! ছিপছিপে গড়নের মেয়েটাকে দেখেই কেন যেন কাছে যেতে ইচ্ছে করে অমিতের। আড় চোখে কয়েকবার তাকিয়ে মেয়েটার অবস্থান দেখে নিচ্ছিল বার বার। চেহারা দেখা যাচ্ছেনা। নীল শাড়ি পরা মেয়েটা হঠাৎ সামনে ফিরে যাত্রী বেঞ্চের দিকে হেটে আসছিল, রাতের এই ঝাপসা আলোতে অমিত তখন চেহারা দেখতে পাচ্ছিলো না। সাহস করে বেঞ্চের দিকেই হাটা দিলো অমিত।
বেঞ্চের কছে আসতেই অমিত নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে নীল শাড়ি পরনের মেয়েটাকে সে ৭ বছর আগে থেকে চেনে!!! এ তো হৃদিতা!!!
নিঃশব্দে পাসে গিয়ে বসলো অমিত, বসার সাথে সাথেই অমিতকে হৃদিতার প্রশ্ন-
-কেমন আছ?
-ভালো, তুমি আমাকে আগেই দেখেছ?
-তোমার চশমার গ্লাস দুটো কিন্তু আগের থেকে মোটা হয়ছে!
অমিত হাসল, হেসে হেসেই জিজ্ঞেস করল, তুমি কেমন আছ?
-ভালো। হৃদিতার নিরুত্তাপ উত্তর।
অমিত আর হৃদিতা একসাথে ভার্সিটি তে পরতো, এক সময় ভালো সখ্যতা ছিল দুজনের। সে অনেক আগের কথা, ভার্সিটিতে অমিত খুব ভালো আবৃতি করতো আর হৃদিতা ছিল তুখোড় তার্কিক! কত সময় কাটিয়েছে ওরা একসাথে, কত কথা, কত ভালোলাগা!
অমিত বলল- কপালে এখনো বিন্দু টিপ পরো!
-তুমিও তো এখনো ডান হাতে ঘড়ি পড়ার অভ্যাস তা ছাড়োনি
-তোমার কথার পিঠে কথা বলার অভ্যাস টা এখনো আছে দেখছি!
-কেন? এখন কি তোমার আগের দিন গুলোর মত রাগ হচ্ছে?
যখন অমিত আর হৃদিতা একসাথে পরত তখন অমিতের খুব রাগ হতো হৃদিতার উপর, কথায় কথায় প্যাচ মারা কথা বলবে এই মেয়েটা! কোন কথারই ঠিক সোজা উত্তর দিতে অনেক কম মানুষই শুনেছে!
অমিত হৃদিতাকে জিজ্ঞেশ করে, ''হিলি কেন এসেছিলে?''
-বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে। তুমি?
-অফিসের কাজে।
-গান শুনবে? প্রশ্ন করেই ১ টা হেড ফোন হৃদিতার দিকে এগিয়ে দেয় অমিত।
-নাহ! এখন না!
অনার্স শেষ করে অমিত মাস্টার্স করার জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়, অনেকটা হুট করে কাউকে না জানিয়ে চলে যায় সে। তখন থেকে যোগাযোগে ছেদ পড়ে! অমিত অনেক চেষ্টা করেছিল হৃদিতার সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু হৃদিতা কোনও সাড়া দেয়নি। হয়ত অভিমানে।
নিরবতা ভেঙ্গে হৃদিতা বলে- ''ছয় মাস আগে দেশে ফিরেছো শুনলাম!
-হ্যাঁ, পরবাসে আর কতদিন !
-দেশের প্রতি টান আছে তাহলে?
-কেন থাকবেনা?
-''আর দেশের ফেলা যাওয়া মানুষ গুলোর প্রতি?''
-''তাদের মায়ায় তো ফিরে এলাম।''
-''মায়া থাকলে ওমনি করে কিছু না বলে চলে গেলে কেন?'' হতো হৃদিতা নিজের কথা ইঙ্গিত করে।
হৃদিতার এই কোথায় কি উত্তর দেবে অমিত খুঁজে পায়না। এই প্রশ্নের উত্তর এখনো জানেনা অমিত। তাই নীরবে বসে থাকে। অমিত যোগাযোগ করতে চেয়েছিল জদিও হৃদিতা করেনি কিন্তু অমিতের বেস্ট ফ্রেন্ড রাতুলের কাছ থেকে সব খবর রেখেছে অমিতের।
''বিয়ে করনি কেন এতদিনে?''- হৃদিতার প্রশ্ন
-''তুমি করেছ?'', অমিতের পাল্টা প্রশ্ন
''কি মনে হয়?'' অভিমানের সুরে হৃদি বাকা প্রশ্ন করে।
আড় চোখে হৃদিতার বাম হারের দিকে তাখিয়ে অমত বলে, ''হাতের আঙ্গুলে তো কোনও রিং দেখা যাচ্ছেনা!''
-তো এবার কি দেশে ফিরেছ বিয়ে করতে?
হুইসেল শুনতে পায় ওরা, ট্রেন চলে এসেছে। দুজনেই উঠে দাড়ায়, হাঁটতে থাকে যার যার নির্দিষ্ট বগির দিকে। হৃদিতা যেই বগিতে উঠেছে তার ঠিক ২ টা বগি পেছনের বগিতে অমিতের কামরা। ধীর পায়ে হৃদিতা কামরার দিকে চলতে থাকে, পিছনের দিকে একবার তাকিয়ে কামরার ভেতরে চলে যায়। অমিত এখনো হৃদিতার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। দূরত্ব বারার সাথে সাথে অমিত অনুভব করতে পারে কোন অজানা চাওয়া।
ট্রেন ছাড়তে শুরু করে, হঠাৎ অমিত হৃদিতার জন্য টান অনুভব করে। ভার্সিটিতে পড়ার সময় তখনকার দিনগুলোতে অমিত আর হৃদিতার প্রেম ছিল কিনা সেটা অমিত আর হৃদিতা কেউ বুঝে উঠেনি। ভালো বন্ধু ছিল দুজন। কখনো বা বন্ধু থেকেও বেশি কিছু। বা অসংজ্ঞায়িত কোন এক সম্পর্কের বাঁধনে জুড়ে ছিল দুটি স্বত্বা। লোকে বলে ''ভালবাসার মানুষ দূরে গেলে নাকি ভালোবাসা প্রবল হয়''। হয়ত অমিত আর হৃদিতার ভালোবাসার প্রয়জনেই দুজনের মাঝে সময় নিজের নিয়মেই দুজনের মাঝে ক্ষণিকের দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছিল। বোকা অমিত বুঝতেই পারেনি হৃদিতাও অমিত কে পছন্দ করতো! কথায় বলে ''নারীর বুক ফাটবে তবু মুখ ফাটবে না।'' অমিতের হঠাৎ চলে জাওয়ায় দুজনের ভালয়ালাগা না বলা থেকে যায়।
অমিত দৌড়ে গিয়ে হৃদিতার কামরায় উঠে পড়ে, হৃদিটার পাশের ফাকা সিটে বসে! হৃদিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অমিতের দিকে!
কোনও কিছু না বলে অমিত আবারো হেডফোন এগিয়ে দেয়!
-গান শুনবে?
-দাও, তোমার পছন্দের গানটা ছেড়ো কিন্তু!
আধার ভেদ করে কু ঝিক ঝিক শব্দে ট্রেন নিরবতা ভেঙ্গে যাচ্ছে। আর অমিত ও হৃদিতার এতদিনের নিরবতা মুছে বেজে যাচ্ছে--
ভুলো মনে চায় সে আজো তোমায় ভোরেরই মৃদু হাওয়ায়...
(সমাপ্ত)
লিখেছেন-শশী হিমু
No comments:
Post a Comment