Responsive Ads Here

20 January 2012

রোদবৃষ্টিতে ভেজা একটি বিকেল....

এক

এই সময়টার এই এক অবস্থা । কিছুক্ষণ আগেও এক ফোঁটাও মেঘ ছিল না । পড়ন্ত বিকেলের কমলা রোদের ছটায় সামনের লেকের পানিটা দিব্যি সোনার মত ঝিকমিক করছিল । এই অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে কি যে হয়ে গেলো, বলা নেই, কওয়া নেই, কোত্থেকে দলা দলা কালো মেঘ এসে আকাশটাকে ছেয়ে ফেলল । হালকা বাতাসও বইছে এখন । ঠাণ্ডা । নিশ্চিত বৃষ্টি হবে । বৃষ্টি, এই ব্যাপারটাকে নীরা একদম পছন্দ করতে পারেনা । বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাট নষ্ট, কাদাপানি, জ্বর, সর্দি, কাশি, আরও কত কি...
অথচ এই বৃষ্টি নিয়েই কত কবিদের আস্ফালন ! বৃষ্টি রোমান্টিক, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কারো সাথে প্রথম দেখায় প্রেম, বৃষ্টিতে প্রেম করতে মজা, বৃষ্টিতে হাঁটার মজাই আলাদা, বৃষ্টি হেন, বৃষ্টি তেন । কি সব ফালতু বোগাস টাইপের ব্যাপার ।
এইতো গতবারও সুমী নীরার কাছে তার একটা রোমান্টিক (নীরার কাছে বোগাস) ঘটনা শেয়ার করছিল । সে আর তার বয়ফ্রেন্ড মিলে রিকশায় করে কোথায় জানি যাচ্ছিলো । বলা নেই, কওয়া নেই, ঝুপ করে বৃষ্টি নামল । তাও আবার যেমন তেমন বৃষ্টি নয়, মুষলধারে বৃষ্টি । কবিদের ভাষায় যাকে বলে ঝুম বৃষ্টি । ইংরেজীতে বলে, কুকুর বেড়াল বৃষ্টি, অর্থাৎ, cats and dogs rain. সুমী তাড়াতাড়ি রিকশার হুড নামাতে গেলো, অমনি তার বয়ফ্রেন্ড সুমীর হাতটা ধরে নাটকের নায়কদের মত করে বলে উঠলো, থাক না... আজ আমরা বৃষ্টিতে ভিজবো । রিকশায় চড়তে চড়তে বৃষ্টিতে ভেজার মজাই আলাদা ।
সুমী তো প্রথমদিকে একটা ধমক দিয়েছিল তার বয়ফ্রেন্ডকে, পরে বৃষ্টির কয়েকফোঁটা যখন টুপটাপ করে ঝরে পড়লো তার গায়ে, সে তো রোমান্টিক হয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে । সে তার বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে নাকি বলেছিল, জানু আমার তো শীত শীত লাগছে । একটু জড়িয়ে ধরবা আমাকে ?
নীরা সাথে সাথে ধমক দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে । রোমান্টিকতার জন্য বৃষ্টির মত একটা ফালতু জিনিসকেই বেছে নিতে হবে কেন, সেটা তার মাথায় ঢোকে না । চাঁদ আছে, জোছনা আছে, গোধূলি আছে, এতো কিছু থাকতে এই ভাইরাসটাকে রোমান্টিকতার কারণ বানাতে হবে !
আজ কি হবে, তার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না । এতো বড় একটা প্ল্যান, এতো বড় একটা আশা নিয়ে সে এখানে এসেছে, এই দিনটার জন্য সে টানা দুই বছর যাবত অপেক্ষা করে আসছে, সেটা যদি এই বৃষ্টির কারণে নষ্ট হয়ে যায়, তবে কিভাবে ? তার চিন্তা বাড়তেই থাকে । পা নাচানো শুরু করে দিলো সে । বেশি দুশ্চিন্তা লাগতে থাকলে এই প্রক্রিয়ায় সে দুশ্চিন্তাগুলো তাড়ায় । আজ দুশ্চিন্তাগুলো এই উপায়ে যাচ্ছে কি না যাচ্ছেনা সে বুঝতে পারছে না ।
ডান হাতের ক্রিস্টাল ঘড়িটাতে সময় দেখল সে । পাঁচটা বেজে গেছে । পাঁচটা বেজে এগারো মিনিট ।
আজিব তো ! মাত্র এগারো মিনিট হল, বসে আছে সে এখানে । আর তার মনে হচ্ছে এগারো ঘণ্টা ধরে সে এখানে বসে আছে !
এই অপেক্ষা ব্যাপারটা যে এত বিরক্তিকর...। উফ... আয়ু কমিয়ে দেবে দুশ্চিন্তায় ।
আচ্ছা এতো দেরি হচ্ছে কেন জাহিদের ? এতো দেরি তো হবার কথা না । সে বিশ মিনিট আগে যখন ফোন করেছিলো, তখন নাকি সে মাঝরাস্তায় । এতক্ষণ তো পৌছার কথা । হঠাৎ করেই একটা ভয়ংকর চিন্তা মাথায় আসলো ওর । খারাপ কিছু হয়ে গেলো না তো ? হৃৎপিণ্ডটা ধড়াস করে একটা বাড়ি খেল । না না, খারাপ কিছু হবে কেন, নিশ্চয় হতচ্ছাড়া রাস্তাগুলোতে জ্যাম বেঁধেছে । তাই এতো সময় লাগছে । ঢাকা শহরের রাস্তাগুলো শহরের রাস্তা তো না, যেন দোজখের রাস্তা এক একটা । উল্টা পাল্টা ভাবনা ভাবার জন্য নিজের গালে মনে মনে কষে একটা চড় কষাল নীরা । গালিও একটা দিলো । সে ভালো গালি দিতে জানে । হতচ্ছাড়ি কি ভাবিস এসব উল্টা পাল্টা...
পা নাচানো বাড়িয়ে দিলো সে । কি যে হল জাহিদের । এদিকে বাতাসটাও বাড়ছে, যে কোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে, নীরা নিশ্চয় বৃষ্টির মধ্যে এখানে বসে থাকবেনা । সে বৃষ্টিকে অনেক অপছন্দ করে । অনেক ।
এমনি তো আর অপছন্দ করে না । বৃষ্টি সে ছোটবেলা থেকেই একদম সহ্য করতে পারেনা । কোনোরকমে বৃষ্টিতে ভিজলেই তার গা কাঁপিয়ে জোর আসে । আর এই জ্বর ছাড়তে কমপক্ষে এক সপ্তাহ তো লাগবেই । একবার কলেজে পড়ার সময়ে জোর করে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে বর্ষাবরণ করিয়েছিল তার চার বান্ধবী । নীরার জান নিয়ে টানাটানি পড়েছিল তখন ।
আজও হয়তো দেখাটা হবেনা তাদের, ভাবল নীরা । গত এক বছর ধরেই দেখা করি করি বলেও দেখাটা হচ্ছেনা তাদের । কপাল আর কাকে বলে ! হয়তো জাহিদের কাজ থাকবে, নয়তো তার । যখন কারোরই কোন কাজ নেই, দেখা গেল অন্য সমস্যা । অন্য সমস্যা বলতে মুডের সমস্যা । নীরার আবার এই বিচ্ছিরি ব্যাপারটা আছে । হুট করেই তার মুড চেঞ্জ হয়ে যায় । তখন স্বয়ং আল্লাহ্‌পাক ছাড়া কেউই আর তা চেঞ্জ করতে পারেনা ।
যত্তসব ! আজ বৃষ্টিটা না আসলেই কি হতোনা ? বেছে বেছে একদম আজকের দিনটাতেই পড়তে হবে বৃষ্টি ?
আল্লাহ্‌ আজ তুমি বৃষ্টি দিয়ো না, তুমি আজ বৃষ্টি দিও না প্লীজ...চোখ বন্ধ করে মনে মনে জপ করতে লাগলো সে । জোরে পা নাচানো, সাথে একটানা বিড়বিড়িয়ে জপ... এই সময় কেউ যদি তাকে দেখে, নির্ঘাত পাগল মেয়ে বলে ভাববে । পাগল একটা মেয়ে লেকের সামনে বেঞ্চিতে বসে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করছে পা নাচাতে নাচাতে, এই দৃশ্য যথেষ্ট আনন্দদায়ক । এক্ষেত্রে সেটা আরও বেশি আনন্দদায়ক হবে, কারণ পাগল মেয়েটা আবার সেজেগুজে বসে আছে । ন্যাংটা পাগল দেখায় মজা নেই, সেজেগুজে থাকা পাগল দেখায় আছে । ধুর... ভাবলে ভাবুক... আমার কি ! যা ইচ্ছা তাই করবো আমি... নীরা পা নাচানোর গতি আরেকটু বাড়িয়ে দিলো ।
কয় মিনিট হল কে জানে ! ডান হাতটা তুলে ঘড়িটা দেখল সে, পাঁচটা বেজে উনত্রিশ মিনিট ! টানা আধাঘণ্টা সে এই জায়গায় বসে আছে !!!
কি যে হল লোকটার ! সময় কাণ্ডজ্ঞান বলতে কি ছিটেফোঁটাও নেই নাকি ! নাকি অন্য কিছু হয়ে...।
ধুর...
পাশে রাখা হ্যান্ডব্যাগটা খুলে মোবাইলটা বের করে জাহিদের নাম্বারটা বের করল সে । কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সে সেটার দিকে । চিন্তা করলো, ফোন দেবে কিনা... । ধুর, ফোন দিয়ে লাভ নেই ।
দেখি, কতক্ষণ বসিয়ে রাখতে পারে । আসলে এমন ছেঁচা একটা দেবো... চোদ্দ গুষ্টির নাম ভুলায়ে ছাড়বো ব্যাটার । মনে মনে ঢাকা শহরের ট্র্যাফিক সিস্টেমের উদ্দেশে সুন্দর, কম আপত্তিকর একটা গালি বেছে নিয়ে দিল নীরা । মোবাইলের গেইম অপশনে গিয়ে সাপের খেলাটা ওপেন করলো । মজার একটা খেলা । এই খেলায় একটা সাপকে ফল খাওয়াতে হয় । সাপটা আবার যত ফল খায়, তত লম্বা হয় । এত ফল যে কেন খাওয়াতে হয়, নীরা জানে না । সে ফল খাওয়াতে মজা পায়, খাওয়াতে থাকে । একসময় সাপটা খেতে খেতে মারা যায় । কেন মারা যায়, সেটাও নীরা ঠিক জানে না ।
স্টেজ ওয়ান...
স্টেজ টু...
স্টেজ থ্রী...
এক্সকিউজ মী, আপনি কি নীরা ?
সাপটা মারা গেলো । গেইম ওভার দেখাল স্ক্রীনে । নীরার হৃৎপিণ্ডটা আরেকবার ধড়াস করে বাড়ি খেল খাঁচাটায়, তারপর দ্রিম দ্রিম ঢোল পেটাতে থাকল । পেছনে তাকাল সে ঘাড় ঘুরিয়ে । লম্বা চওড়া একটা লোক দাঁড়িয়ে । মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল নয়, কোঁকড়া চুল, সামান্য লম্বা । খয়েরি নয়, সাদা পাঞ্জাবী পরনে । গ্রে গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট পরার কথা ছিল, নীল জিন্স পরা ।
আস্তে করে মাথা ঝাঁকিয়ে দাঁড়ালো সে । লোকটার মুখে একটা ছোট্ট রোদেলা হাসি ছিল , নীরা তাকাতেই হাসিটা মিলিয়ে গেলো কালো মেঘের আড়ালে ।
সে আগের মত করেই বলল, আপনিই নীরা ?
নীরা কণ্ঠস্বরটা শুনে সামান্য চমকাল । জাহিদের কণ্ঠ নাকি ?
এতো তার সেই পরিচিত কণ্ঠ নয়, যার সাথে সে কথা না বলে একটা দিনও থাকতে পারে না ! প্রথম দিকে মনে হয়েছিল, সেই কণ্ঠস্বরই, হঠাৎ করেই এতো দূরের হয়ে গেলো কেন !
জি, আমি নীরা । আপনি কি জাহিদ ?
না...আমি বন্ধু...
নীরার ভেতরটা হঠাৎ করেই কেমন যেন করে উঠলো । বুকের ভেতরটা এখনও দ্রিম দ্রিম বাজছে মৃদু শব্দে । সে কাঁপা কণ্ঠে বলল, মানে !
আমি জাহিদের বন্ধু, রাতুল ...
নীরা কি বলবে ভেবে পেল না হঠাৎ । তুমি... মানে আপনি জাহিদ নন ?
না... আ...আসলে জাহিদ আমাকে পাঠিয়েছে...
নীরার বুকের ভেতরের দ্রিম দ্রিম শব্দ বেড়ে গেলো । আপনি জাহিদ নন ?
লোকটা সামান্য হেসে মাথা নিচু করে আবার নীরার দিকে তাকাল । না, আসলে,... আসলে, জাহিদ আমাকে পাঠিয়েছে ।
কেন !তার কি হয়েছে ! নীরার কণ্ঠস্বর কেঁপে গেলো আবার ।
না, তার কিছুই হয়নি...। আচ্ছা আমি এখন যাই, আমার একটা কাজ ছিল... আমি জাহিদকে আসতে বলবো কাল ।
নীরা আর কিছুই বলতে পারলো না । সে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চেয়ে থাকলো লোকটার যাওয়ার দিকে ।জাহিদের দিকে ।
হ্যাঁ, জাহিদই তো ! কোন ভুল নেই । হয়তোবা জাহিদের দেওয়া নিজের বর্ণনার সাথে এর কোন মিলই নেই । তবুও নীরার কেন মনে হচ্ছে, এই লোকটাই জাহিদ ?
পুরনো কথাগুলো ফ্ল্যাশব্যাক হয়ে আস্তে লাগল তার চোখের সামনে । জাহিদের আচমকা ফোন । রং নাম্বারে । নীরার নাম্বার । নীরা কখনো কোন ছেলের সাথে এত কথা বলেনি ফোনে । তার ফোনে এত কথা বলার মত কেউ ছিলনা । জাহিদের সাথে কথা হত, সেই ফোন দিত । ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে নীরাকে আচ্ছন্ন করে রাখত ।
আচ্ছা জাহিদ আমি কিন্তু দেখতে একটুও সুন্দর না ।
না, তুমি মিথ্যে বলছ , যাতে আমি বলি তুমি অনেক সুন্দর । মেয়েরা পুরুষদের মুখে নিজের রূপের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে ।
না জাহিদ, সত্যি । আমার গায়ের রং ময়লা ।
কোন অসুবিধা নেই, আজকাল লাক্স সাবানগুলো এক ঘসা দিলেই অনেকখানি ফর্সা হওয়া যায় ।
আমার নাকটা চ্যাপ্টা ।
টেনে লম্বা করে দেব ।
আমার চুলগুলো খাট ।
সানসিল্ক শ্যাম্পু ইউজ করো, ঠিক হয়ে যাবে ।
জাহিদ আমি দেখতে খুবই খারাপ ।
আমিও দেখতে খারাপ । খারাপে খারাপে ভালো হয়ে যাবে । আমি খারাপকেই ভালোবাসি । মাইনাসে মাইনাসে প্লাস, হাহাহা ।
জাহিদ তুমি কি আমায় ভালোবাসো ?
কি মনে হয় তোমার ?
বাসো না ।
ভুল, তোমায় অনেক ভালোবাসি আমি । কল্পনাও করতে পারবে না ।
আমাকে দেখার পরও আমাকে এভাবে ভালবাসবে ?
সেটা তোমাকে দেখার পর বলতে পারবো ।
নীরাকে হঠাৎ কি একটা শূন্যতা জড়িয়ে ধরল যেন । দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেলনা সে । আবার বেঞ্চটাতে বসে পড়লো । অনেক চিন্তা এসে ধাক্কা দিয়ে যেতে লাগলো তাকে । বেচারা জাহিদ । নীরাকে দেখে পছন্দ করতে পারেনি । নীরার কথা যদি একটুখানি পাত্তা দিত সে, এটা হয়ত ঘটতো না । নীরা বলেছিল সে আগে নিজের একটা ছবি জাহিদকে পাঠাবে । সে আগে সেটা দেখুক । জাহিদ হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল ।
নীরা একটুখানি ভেবেও রেখেছিল এই ব্যাপারটা নিয়ে । ব্যাকগ্রাউণ্ড ব্যাপারটা নিয়ে । সে জানে তার চেহারা চোখে পড়ার মতই খারাপ, তাই ভাবা । সে ভেবে রেখেছিল, জাহিদ যদি তাকে পছন্দ না করে, সে জাহিদের মুখের উপর খলবল করে হেসে দেবে । বলবে, জাহিদ সাহেব, আমি কিন্তু নীরা না । আমি নীরার ফ্রেন্ড তমা । নীরা দেখতে ডানাকাটা পরীর মত । আপনি কি ডানাকাটা পরী দেখেছেন কখনো ? দেখেননি ? তমাকে দেখলেই দেখা হয়ে যাবে । চিন্তা করবেন না । আপনি এতদিন তমার সাথেই কথা বলেছিলেন ।
তারপর নীরা হেসে চলে আসত । তার চোখে এক ফোঁটাও পানি আসবে না । পানি আসবে কেন, সে তো জানতই আগে থেকে, এটা হবে । তারপর সে তার বান্ধবী তমার সাথে জাহিদের পরিচয় করিয়ে দিত । তমা দেখতে সুন্দর, জাহিদের নিশ্চয় অনেক পছন্দ হবে ।
নীরার প্ল্যানটা কিভাবে কিভাবে ভেস্তে গেল । জাহিদ তাকে কথা বলারও সুযোগ দিল না ।
বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ল নীরা । সে এখন হাঁটবে । বৃষ্টি আসবেনা আর বোধহয় ।
মোবাইলের মেসেজ টোনটা রিনিঝিনি শব্দে বেজে উঠল হঠাৎ । নীরা তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা খুলল । জাহিদের মেসেজ !
“নীরা আমি সত্যি অনেক দুঃখিত । মা বাবা আমার জন্য মেয়ে দেখে রেখেছেন । মা হার্টের রোগী, সে মেয়েকে বিয়ে না করলে মা অনেক কষ্ট পাবেন । ভালো থেকো ।”
মেসেজটা পড়ার পর নীরা জাহিদের নাম্বারটা ডিলিট করে দিল মোবাইল থেকে । আমি ভালো থাকব জাহিদ । আমি ভালো থাকব । মনে মনে বলল সে ।
নীরা এখন রাস্তায় । আস্তে আস্তে ফুটপাত ধরে হাঁটছে সে । নিজেকে খুব এলোমেলো লাগছে তার । জাহিদের কথায় নীল শাড়ি পরে এসেছিল সে । সে জানে, নীল রঙের শাড়িতে তাকে ভূতুড়ে দেখায় । লোকজন অবাক চোখে মাঝে মাঝে তার দিকে তাকাচ্ছে ।
রাগে নীরার গা জ্বলতে শুরু করেছে । লোকজন তার দিকে এমন করে তাকাবে কেন ! সে কি চিড়িয়া ? সে দেখতে খারাপ তো কি হয়েছে ? নীল শাড়িতে তাকে ভূতুড়ে দেখায় তো কি হয়েছে ? এভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে ?
গালে হঠাৎ পানির স্পর্শ পেল নীরা । বৃষ্টি হচ্ছে নাকি ? সে আকাশের দিকে তাকাল । না তো, এক ফোঁটাও মেঘ নেই কোথাও ।
তার গাল বেয়ে আরও দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল ।
আজিব ! কাঁদছি কেন আমি ! আমার তো কাঁদার কথা ছিল না । সে তাড়াহুড়ো করে চোখ দুটো মুছে নিল ।
সে কাঁদবে কেন , কাঁদার মত কিছুই হয়নি । সে তো জানতই, জাহিদ তাকে পছন্দ করতে পারবেনা । ভালোবাসা পেতে হলে মেয়েদের সুন্দর চেহারা আর সুন্দর শরীর থাকতে হয় । অসুন্দর হলে কোন পুরুষই তাদের পছন্দ করতে পারে না । ভালোবাসা হয় সুন্দর চেহারা আর শরীরে, মনে নয় ।
আল্লাহ্‌ তুমি বৃষ্টি দাও কিছুক্ষণের জন্য, বৃষ্টি দাও কিছুক্ষণের জন্য... একমনে জপ করতে থাকল নীরা ।
আকাশে মেঘের কোন ছিটেফোঁটাও নেই আর এখন ।

দুই

সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই নীরার হাতে একটা প্যাকেট গুজে দিলেন তার মা । প্যাকেটটা র‍্যাপিং পেপারে মোড়ান ।
আজিব তো ! এই সকালবেলা কে তাকে এই জিনিস পাঠাবে !
প্যাকেটটা খুলে ফেলল নীরা । একটা লাল গোলাপ রাখা সেখানে । আর একটা চিঠি । চিঠিটা খুলতে গিয়ে হাত কাঁপতে লাগল তার।
মনে মনে নিজেকে গালি দিল সে । তার হাত কাঁপবে কেন !
“প্রিয় নীরা,
এই সম্বোধনটা নিজ থেকেই করলাম । আমি মনে করি, সম্বোধনটা করার মত আমার পুরো অধিকারই রয়েছে । তুমি সবসময় বলতে তোমার চেহারা খারাপ, যা তা অবস্থা । নিজের চোখে দেখার পর তারপর বিশ্বাস করলাম । গতকালের ঘটনাটা তোমার কেমন লেগেছে, জানতে ইচ্ছে করছে ।
আমার কিন্তু গতকালের দিন আর ওই সময়ের মুহূর্তটা সারা জীবন মনে থাকবে । তোমার মুখের চেহারা দেখে মনে হয়েছিল, তুমি কেঁদে দেবে । ভাগ্যিস কাঁদোনি, কাঁদলে একটা বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে যেত । আমি কিছুতেই লোকজনকে সামলাতে পারতাম না । গণপিটুনি একটা অবশ্যই খেতে হত আমাকে । সেজন্য তোমাকে অনেক থ্যাংকস ।
আমি অতিশয় আনন্দিত এই ভেবে যে, তুমি আমাকে ভালবাসতে পারনি । আমার যাওয়ার সময় বারবার মনে হয়েছিল, তুমি আমাকে ডেকে ফেরাবে । আমাকে ভালবাসতে না পারার কারণটিও বোধহয় আমি আঁচ করতে পারছি ।
নিজের চেহারা এত খারাপ ভাবার কোন কারণ নেই । এটা যে তোমার বিচ্ছিরি একটা বদঅভ্যাস, সেটা নিশ্চয় আমার মুখে বলে দিতে হবে না । আশা করব, আমাদের বিয়ের পর তোমার যত বিচ্ছিরি বদঅভ্যাস আছে, সব একটা একটা করে ডিলিট করে ফেলবে ।
আমি খেয়াল করেছি, তুমি প্রচুর মিথ্যা বল । তুমি মনে কর, আমি বুঝতে পারিনা । আমি পারি । কারণ তুমি মিথ্যা বলতে পারনা । আমি পারি । অনেক ভালই পারি, তবে বলিনা । আর আমি যে ভালই মিথ্যা বলতে পারি, গতকালই সেটা প্রমান করে দিয়েছি । তুমি রাতুলের কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছ নিশ্চিত । এটা ঠিক না । তোমার যখন ছেলেপুলে হবে, তারা তো তাদের মার কাছ থেকেই সব মিথ্যা শিখে নিতে পারবে ! আর তুমি নাকি বৃষ্টিতে ভিজতে পারনা । বৃষ্টিতে ভিজা অভ্যাস করে নাও । কারণ আমার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রিকশায় চড়ার, চা খাওয়ার, হেঁটে বেড়ানোর বদ অভ্যাস আছে । আমি নিশ্চয় তোমার ফালতু বদঅভ্যাসের জন্য আমার সুন্দর বদঅভ্যাসগুলোকে ছাড়বনা ।
আজকে বৃষ্টি হবে । তুমি আজকের বৃষ্টিতে অবশ্যই ভিজবে । আজ পনের মিনিট ভিজলেই চলবে । আস্তে আস্তে ডিউরেশন বাড়বে । তারপর বিশ মিনিট, তারপর আধা ঘণ্টা । তারপর এক ঘণ্টা । তারপর সারাদিন । একসময় দেখবে, আর কোন প্রবলেম হচ্ছেনা ।
গতকাল শেষ বিকেলের আলোয় নীল শাড়িতে তোমাকে অপূর্ব লাগছিল । আজ বিকেলেও আশা করি নীল শাড়ি পরেই আসবে । আমি কথা দিলাম খয়েরি পাঞ্জাবী আর গ্রে গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট পরেই আসব আজ ।
----জাহিদ

বিকেল । টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে । নীরা আবারো নীল শাড়ি পরেছে আজ । পার্কের লোকজন মাঝে মাঝেই তার দিকে তাকাচ্ছে । তাকাচ্ছে, তাকাক । মানুষের প্রতি মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই । সে কারণে প্রাথমিক কৌতূহল চাহনি দিয়েই মেটাতে হয় ।
বৃষ্টি থামছেনা । নীরা জানে, এই বৃষ্টি সহজে থামবেও না । কিছুক্ষণ পরেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হবে ।
টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজতে তার আজ ভালই লাগছে । মনে মনে ভাবতে লাগল সে, ইস, হালকা রোদ থাকলে আরও ভাল হত । বৃষ্টিভেজা রোদে ভিজতেও নিশ্চয় অনেক মজা ।

লিখেছেন-Ovi Talukder

No comments:

Post a Comment