Responsive Ads Here

20 January 2012

অসমাপ্ত গল্প

লাল সূর্যটা ডুবছে । বেলাশেষে দূরের
পাখিগুলো ঘরে ফিরছে । পড়ন্ত বিকেল আজ কিচির
মিচির শব্দে মুখরিত । একটা শালিক
কোথা থেকে উড়ে এসে যেন অর্নবের বেঞ্চে বসল ।
অর্নবের মুখের দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে এই নিরীহ
পাখিটাও তার মনের ভেতরটা বোঝার
চেষ্টা করে ব্যর্থ হল । অর্নবের কাছে চারপাশের
সবকিছুই পরিচিত শুধু তার মাঝে তার নিজেকেই
অপরিচিত লাগছে । কিছুক্ষন
আগে ঘটে যাওয়া মুহুর্তগুলো বিশ্বাস করতে বেশ
কষ্ট হচ্ছিল অর্নবের কিন্তু বাস্তবতা তার
কাঠিন্যের মাত্রাটা যতই পেরিয়ে যাক না কেন ,
নীরবতার সাথে মানুষকে তা মাথা পেতে নিতে হয় ।
চিরাচরিত এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটনোর সাধ্য
অর্নবের ও আজ নেই ।


************************************


- ছেলে ডাক্তার ।


- ভালোই তো , তুমি ও medical student
দুজনেই doctor । সুখী হবে তোমরা ।


- তোমার কি মনে হয় আমি মজা করছি ?


- নাহ্ । আমার মত ভবঘুরে ছেলের সাথে নিজের
জীবনটা না জড়ানোটাই ভাল প্রিয়তি । কোথার
ডাক্তার আর কোথায় আমি গ্রাজুয়েশনটাই কমপ্লিট
করতে পারলাম নাহ্ ।


- তুমি কি এটাই চাও ?


সত্যিই খুব ভালো হত
যদি মুখ ফুটে বলতে পারতাম না চাই
না আমি তোমাকে নিয়ে দেখা সব
স্বপ্নগুলোকে এভাবে শেষ হয়ে যেতে দিতে । কিন্তু
কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো তোমার family র কাছে ?
তোমার অর্নবটা যে একেবারে অকর্মন্য । নিজের
এর ঠিক নেই , তোমাকে নিজের জীবনের
সাথে কীভাবে জড়াই বলো ? মনে মনে ভাবে অর্নব ।


- কি ভাবছ ?


- না কিছু না । অনেক সুখী হও
প্রিয়তী । তোমার বাবা মাও অনেক খুশি হবেন ।


- মানে ? তুমি একবার ও
গিয়ে বলবে না তুমি আমাকে....


- এখন আর এটা হয় না ।
দূর্ভাগ্যের সন্মূখে প্রিয়তি আজ অর্নবের চোখের
দিকে তাকাতে ও ভুলে গেল । অন্য কোন দিন
হলে হয়ত অর্নবের ঐ শান্ত চোখ দুটোই বলে দিত
তার মনের অব্যক্ত কথা কিন্তু আজ অর্নব ও হয়ত
চাইছিল অশ্রুভরা দু চোখ লুকিয়ে রাখতে ।
অর্নবের নিরবতা আজ প্রিয়তিকে স্তব্দ করে দিল


- ভালো থেকো ।


প্রিয়তির একটা দীর্ঘ শ্বাসে অর্নব তার নিজস্ব
ঘোরের গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসে । একটা অদ্ভুত
অনুভূতি আজ অর্নবের সমস্ত শরীরে শিহরন
এনে দিচ্ছে ।


" ও কি আমাকে কাপুরুষ ভাবল ? হয়ত ! "


জুবেরী পার্কের পশ্চিমে কয়েকটা ভাঁট ফুল জংলা হয়ে আছে । নির্জনতাকে ভেঙ্গে দেয় কয়েকটা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক । নীল আকাশে আস্তে আস্তে ভর করছে কালো অন্ধকার , ঘন কালো অন্ধকার । হাঁটতে হাঁটতে কখন যে অর্নব বড় রাস্তার মোড়ে চলে এসেছে নিজেও বুঝতে পারেনি । চোখ ভর্তি ক্লান্তি আর অবসাদ নিয়ে সে হেঁটে চলেছে নিরন্তর পথে । হয়ত নিজেও জানেনা সে এই হেঁটে চলা পথের অন্ত কোথার ।



হঠাত একটা প্রচন্ড ধাক্কায় তার সমস্ত শরীর নিথর হয়ে আসে । মনে হল যেন তরল কিছু তার জীর্ন শীর্ন শরীরটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে । অসহ্য একটা ব্যাথা তার চারপাশের সবকিছুকে ঘোলাটে করে দিল ।


************************************


Sence ফিরতেই অর্নবকে ঘিরে ফেলল একটা তীব্র ব্যথার অনুভূতি । তীব্র ফিনাইলের গন্ধে টের পেল এটা হসপিটাল । একটা ছোট কেবিনে একটা মাত্র বেড যাতে শুইয়ে রাখা হয়েছে তাকে । পাশেই টেবিলেব উপর ডিবি করে রাখা ফাইল । বড্ড ক্লান্তি লাগছে অর্নবের । বেড থেকে তড়িঘড়ি করে উঠবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সে , মনে হয় যেন শক্ত একটা প্রাচীর ঘিরে ধরেছে তাকে । একটু ঘুরে তাকেতেই চমকে যায় অর্নব । জানালার বাইরে বিষন্ন ভাবে তাকিয়ে আছে একটা মেয়ে । অর্নব বুঝতে পারে এই মেয়েটার জন্যই তার এ যাত্রায় বেঁচে যাওয়া


- অবশেষে আপনার sence ফিরল ।


অর্নবের দিকে ফিরে মিষ্টি একটা হাসি দেয় মেয়েটি ।


- আপনি কাল accident করেছেন আমাদের গাড়িতে । অবস্থা এত খারাপ হয়ে যায় যে নিজ দায়িত্বে আপনাকে হসপিটালে নিয়ে আসে driver ।


" মানুষ যা চায় তা পায় না , আর যা পায় তা চায় না " কথাটা যে কতটা নির্ভুল তা বেশ বুঝতে পারছে অর্নব । একটা "না" এলোমেলো করে দিয়েছে তার জীবন ।


সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসে অর্নব । কিন্তু প্রিয়তির কথাগুলো তাকে এত বেশি বিভোর রাখে যে সে ভুলেই যায় তার বেঁচে ওঠার পেছনে সেই অচেনা মেয়েটার কথা । মেডিকেল ফাইল থেকে মেয়েটির Contact Number খুঁজে পায় অর্নব । একটা ধন্যবাদ না জানানো পর্যন্ত নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে তার ।


- হ্যালো আসসালামুআলাইকুম । এটা কি নাবিহার নাম্বার ?


- আপনি ?


- Mother Teresa দের কি তাদের রোগীদের কথা ভুলে গেলে চলে ?


- ওহ্ আপনি ? কেমন আছেন ?


- ভালো তো মনে হয় । আজ আপনি না থাকলে হয়ত আমি এখানে থাকতাম নাহ্...


************************************


সন্ধা শেষ । ইট পাথরের এই নগরে আকাশে চাঁদ খোজা । তার সাথে শরতের এক চিলতে আকাশের শুভ্র জমিন মেলানো , রীতিমত কষ্টসাধ্য ব্যাপার ! এই মেকি প্রলেপে আচ্ছাদিত শহরে আলোর কোন ও অভাব নেই ! রাজপথ থেকে গলিগুলো , সর্বত্র ই আলোর জয়জয়াকার । শুধু আলো নেই মানুষের মনে । চাঁদ তারার আলো , বহু আলোকবর্ষ পেরিয়ে এসে সহস্র আলোর ভিড়ে থমকে দাঁড়ায় । পায় না মানুষের মনে প্রবেশের সিংহ দরজার খোঁজ । যার ফলশ্রুতিতে কোন অন্ধকার কানা গলির মতই ঘোর অমানিশায় আচ্ছাদিত থাকে মানুষের মনের প্রতিটি কোন ।


বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিশাল শপিং মলটায় আলোর খেলা দেখছিল আর আপন মনে এ সবই ভাবছিল অর্নব । অপেক্ষায় আছে জন্ম জন্মান্তরের অপেক্ষায় । একসময় ঘনকালো মেঘটা ঢেকে ফেলেছিল তার চারদিকটা । কিন্তু নিয়তি তাকে আজ জীবনের অন্য মোড়ে নিয়ে এসেছে । তাইতো সে অপেক্ষায় আছে নাবিহার ফোন কলের জন্য । নাবিহার একটু আশ্বাস না পেলে জীবনটাকে এখন অর্থহীন মনে হয় অর্নবের । অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে প্রযুক্তির দান মোবাইল ফোনটির দিকে । কত দূরত্ব নিমিষেই ঘুচিয়ে দেয় এই ছোট্ট জিনিষটি । ফোনটি বেজে উঠতেই দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে অর্নব ।


- Sorry একটু দেরি হয়ে গেল ।

- Its ok... ব্যাপার নাহ্ ।




নাবিহাকে আজ ঘিরে রয়েছে উদ্বিগ্নতা । আজ পারিবারিকভাবে একটি ছেলের সাথে বিয়ের কথা ঠিক হয়েছে তার । কিন্তু অর্নবকে বলতে পারছে না সে , কারন বেকারত্বের দেয়ালটা আজো ভাঙ্গতে পারেনি অর্নব । নাবিহার কাছে অর্নবের ভালবাসার স্পর্শটাই সবকিছু । তবু সে অর্নবকে বলতে পারছে না তার উদ্বিগ্নতার কথা পাছে প্রিয়তীর মত তাকেও ফিরিয়ে দেয় অর্নব । অনেক কষ্টে অর্নবকে তার অনুতাপের শিকল থেকে মুক্ত করতে পেরেছে নাবিহা । কিন্তু আবার সেই বিষাদময়তার দিকে অর্নবকে ঠেলে দিতে পারবে না নাবিহা । পারবে না নিজের জীবন থেকে অর্নবকে হারিয়ে ফেলতে ।


- একটা Good News আছে ।


নাবিহার নিরবতা ভাঙ্গল অর্নব ।


- বেকার অর্নব নামটা ঘুচে গেল আজ । একটা multinational কোম্পানিতে চাকরীটা হয়ে গেল আজ ।


স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নাবিহা । ঠিক করে কাল সামনাসামনি অর্নবকে বিয়ের কথাটা বলবে ।


- কাল সেই জুবেরী পার্কটায় আসতে পারবে নাবিহা ? কিছু কথা বলার আছে ।


- হুম পারব । আমার ও অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে ।



ফোনটা রেখে দেয় অর্নব । প্রিয়তিকে ফিরিয়ে দেয়ার পর জীবনটা বিষাদময়তায় ভরে উঠেছিল তার । সেই দিনগুলোতে ভয়াবহ অনুতাপ আর কষ্টে ডুবে থাকত অর্নব । অন্য বন্ধুরা যখন তার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল , তখন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল অচেনা মেয়ে নাবিহা । দূরে না গিয়ে কাছে এসেছিল সে । অনুতপ্ত অর্নব প্রায়ই নিজেকে কাপুরুষ বলে জীবনের প্রতি নির্লিপ্ততা দেখাত । একদম একা এই অর্নবকে সমস্ত একাকিত্ব থেকে দূরে এনে নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছিল নাবিহা । রাগে , হতাশায় , কষ্টে , অনুতাপে নাওয়া খাওয়া প্রায় ভুলতে বসেছিল অর্নব , ভেঙ্গে পড়েছিল স্বাস্থ্য , হাতে উঠে এসেছিল সিগারেট নামক ধ্বংসদন্ড । সবকিছু জেনে ও বন্ধুত্ব আর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল নাবিহা । অর্নবের সমস্ত মন জুড়ে নাবিহার জন্য জমে উঠেছিল পাহাড় প্রমান কৃতজ্ঞতা কখন যে এই কৃতজ্ঞতাটাই ভালবাসায় পরিনত হল তা নিজেও জানেনি অর্নব । অতীতের কথা ভেবে বেকারত্বের বেড়াজাল ছিড়ে নাবিহাকে বলতে পারেনি "ভালবাসি" .কিন্তু আজ আর কোন বাধাঁ নেই । কাল সকালেই নাবিহাকে বলবে সে তার মনের কথা ।


************************************


আজ নাবিহার গায়ে হলুদ । সকাল থেকেই মেয়ের দল এসে অপরুপ সাজে সাজিয়েছে তাকে । তাকে এতটা সুন্দর আগে কখন ও লাগেনি । ঘরে সোনা রুপার পানি ছিটানো হচ্ছে যেন কারো নজর না লাগে !


বাড়িতে আজ লোকের সমাগমে হইচই আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে । সবার মাঝে উঁকি দিয়েছে খুশির সূর্য ।

একটু পরই অনুষ্ঠান শুরু হবে । ছাদে সামিয়ানা টানানো হয়েছে । এককোনে তৈরী করা হয়েছে ফুলেল স্টেজ । সারা বাড়িতে একটা সাঁজ সাঁজ রব পড়ে গেছে । সবাই সাজতে ভীষন ব্যস্ত । কার আগে কে সাজবে সেটাই মূখ্য বিষয় ।


************************************


নাবিহার ফোনটা রেখেই অর্নব নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে । ভোরবেলা উঠেই নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করে । অনেকক্ষন ভেবে চিন্তে অবশেষে নীল শার্টটা পড়ে নিল সে । আয়নায় নিজেকে দেখে একটু মুচকি হাসল সে । বাসা থেকে বেরিয়েই কতকগুলো গোলাপ কিনে নেবে সে । জুবেরী পার্কটা খুব দূরে নয় ওখান থেকে । কিন্তু বিধাতা বুঝি পাশার ছক অন্য ভাবে সাজিয়েছিলেন তাইতো সভদূতরুপী মাইক্রোবাস তাকে চাপা দেয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত খেয়াল করেনি অর্নব । রক্তে লাল হয়ে যায় তার নীল শার্ট । শুধু হাতে রয়ে যায় নাবিহাকে দেবার জন্য কেনা একগুচ্ছ লাল গোলাপ ।


অর্নবের রক্তাক্ত প্রানহীন দেহটা দেখে একটু ও কাঁদেনি নাবিহা । শুধু হাত থেকে গোলাপগুলোকে নিয়ে ওর রক্তাক্ত মাথায় বুলিয়ে দিয়েছিল হাত । সেদিন থেকে একদম চুপচাপ হয়ে যায় নাবিহা , ভিতরে ভিতরে অসহ্য যন্ত্রনা আর কষ্টগুলো ঘিরে ফেলে তাকে । বাসায় তার বিয়ে আয়োজন হলেও কোধ প্রতিক্রিয়া হয় না তার । নিজের জীবনটাকে কঠিন বোঝা মনে হতে থাকে তার কাছে ।


************************************


অর্নবের সেই গোলাপগুলো শুকিয়ে গেছে । তবু আজ ও আকঁড়ে রেখেছে নাবিহা । গোলাপগুলো হাতে নিয়ে পায়ে পায়ে ছাদে উঠে আসে নাবিহা । ছাদটা অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে । শুন্য চেয়ারগুলোর সাথে একেবারে চোখাচোখি হয় তার । ছাদের কিনারায় এসে রেলিং পেরিয়ে কার্নিশে এসে দাঁড়ায় সে । দলতলার নিচের রাস্তায় অগনিত যানবাহনের চলাচল । নীল আকেশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে দু হাত প্রসারিত করে নাবিহা । তার শান্ত ঠোঁট দুটি ধীরে ধীরে বলে ওঠে --


" আমি বুঝিনি ঢেউ কেন আছড়ে পড়ে সৈকতে । বুঝিনি বাতাস কেন থমকে দাঁড়ায় । শুধু সাগরের অতলে ডুবে থাকা নোনা জলের রূপালী ঝিনুকের মত এ বুকে তিলে তিলে জমিয়িছি ভালবাসা । "


অবশেষে কি এক অপার্থিব হাসিতে মাখা কান্নায় উদ্ভাসিত হল নাবিহার মুখ । আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় নাবিহার কান্নাভরা চিত্‍কার --


" অনেক ভালবাসি তোমাকে অর্নব । কি করে ভাবলে তোমায় ছেড়ে থাকব আমি ? আমি আসছি তোমার কাছে । তোমার সেই গোলাপগুলো নিয়ে বেনারসি পড়ে বধূ সেজে তোমার বুকে ফিরে আসছি ........... "




Nusrat Jahan Ishat
28. 12. 2011

No comments:

Post a Comment