৭১-এর মার্চ মাসের সেই দিনগুলি এখনো ভুলিনি । আসলে সেই দিনগুলি ভোলার মত নয় ।আমরা তখন থাকতাম গোপিবাগে ।১৯৭১-এর ২৫ শে মার্চের সেই রাতের পরে আরো দুটো দিন ও রাত ছিলাম আমাদের সেই বাসায় । দু’দিনই রাতে ঘুমাতে গেলাম বাড়ীওয়ালার ঘরে , সবাই একসাথে নিরাপদ বোধের জন্য বোধকরি ।মনে আছে রাতে শুনতে পেতাম গুলির শব্দ আর দেখতে পেতাম দূরের আগুনের লালচে আভা । তখন আমি বেশ ছোট তাই প্রথমে বধহয় তেমন ভয় পাইনি, পরে অনেক ভয় পেয়েছিলাম ।আমাদের মহল্লায়ই ভাড়া থাকতো সিনেমায় ছোট খাটো চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পি অমিতা বশু-র পরিবার । ওঁদের কথা মনে আছে এখনো কারন ওনার ছেলের সাথে আমি খেলতাম । সেদিন দুপুরে হঠাৎ উনি কাঁদতে কাঁদতে এসে আম্মাকে বল্লেন যে পাকিস্তানি মিলিটারি-রা এই শহরে কাউকে জীবিত রাখবেনা , মেরে ফেলবে । তাই ওনারা চলে যাচ্ছেন এবং সত্যি সত্যি চলে গেলেন সুধু কিছু কাপড়-চোপর নিয়ে। পাশের বাসার পোষ্ট মাস্টার সাহেবের মেয়ে জামাই চলে এলেন অন্য এলাকা (খুব সম্ভবত মোহাম্মদ পুর থেকে)। খুশি হয়ার বদলে সবাই কান্নাকাটি । ওনাদের নাকি বিশাল ক্ষতি হয়েছে । মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছেন ।আম্মা বল্লেন এখানেও নিরাপদ না, আমরা নারিন্দা আমার খালার বাড়ীতে চলে যাই । ওখানে বড় পাকা দালান আছে । কার্ফিউ কিছুক্ষনের জন্য সিথিল হতেই আমরাও নিজেদের বাসা ছেরে নারিন্দায় চলে গেলাম । পেছনে পরে রইল ঘর , সমস্ত জিনিস পত্তর । ওখানে গিয়ে দেখি ওই বাসায় কেউ নাই তবে কিছু বাজার সদায় রান্নাঘরে ঠিকই আছে । আমার নানি একটু কিছু রান্না করে আমাদেরকে খাওয়ালেন । আমার ছোটবোন সুইট তখন খুবই ছোট । তাতে কি ওরও তখন শব্দ করতে মানা । পরের দিন আমার আম্মা আর উপরের তলার একজন মহিলা গেলেন নারিন্দার শাহ্ সাহেব বাড়ীর পীরের কাছ থেকে পানি পড়া আর তাবিজ আনতে যাতে আমাদের কোন বিপদ না হয় । কিছু একটা এনেছিলেন বোধহয় , কিন্তু তারপরেও আমাদের কোন শব্দ না করে চুপ চাপ থাকতে হতো ঘরের দড়জা জানালা বন্ধ করে । এভাবে ওখানে দু’তিন দিন ছিলাম বোধহয় । একদিন দুপুরে হাপাতে হাপাতে বড় মামা এসে হাজির । আমাদের গোপিবাগের বাসায় গিয়ে আমাদেরকে না পেয়ে এখানে এসেছেন ।বল্লেন এখানে থাকা চলবেনা । উনি ওনার পুরো পরিবার , শ্বশুর-শ্বাশুরী সবাইকে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কথাও একটা গ্রামে রেখে এসেছেন । তার আগের পুরো রাত্র নাকি মাটির গর্তে কাটাতে হয়েছে । ঢাকা শহরে কোন ভাবেই থাকা যাবেনা । মামা নাকি কোন সরকারী কর্মচারী সংগঠনের কি ছিলেন এবং আন্দোলনের সময়ে অফিসের কোন এক বিহারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে ঘুসি মেরেছিলেন , তাই ওনাকে পেলে এখন মেরেই ফেলবে ।
সময় নেই এখনি রওয়ানা দিতে হবে । সাথে সাথেই ছোট একটা সুটকেস আর একটা কাপরের পুটলি বানিয়ে নারিন্দা থেকে রওনা হলাম ।(ঝাপসা মত মনে আছে)খুব সম্ভবত সদর ঘাটের কাছাকাছি কোথাও দিয়ে নদী পার হবার জন্য আমরা নৌকায় করে যাচ্ছি । হঠাতই মনে হল ওই বুঝি একটা মিলিটারী বঝাই মোটর বোট আমাদের দিকে আসছে । আমার আম্মা আর নানী কি যেন একটা ছুরা বা দোয়া জোরে জোরে পড়ছিলেন আর আমাদের দুই ভাই-বোনকে জরিয়ে ধরে রেখেছিলেন । ওহ,ওইটুকু বয়সে সে যে কি ভয়ানক ভয় পেয়েছিলাম । কিন্তু মিলিটারী বোট-টা অন্যদিকে চলে গেল । বুড়িগঙ্গা পার হয়ে অনেক দূর হেটে আর কিছুটা বোধহয় রিকসায় করে গিয়েছিলাম ।যদি ভুলে গিয়ে না থাকি তাহলে জায়গাটার নাম ‘বাঘৈর’।
ওখানে এক হিন্দু বাড়ীতে আমাদের আশ্রয় হলো । আমার মামী , ছোট ছোট মামাত ভাই-বোন সবাইকে ওখানে পেলাম । সাথে দেখলাম আরো অনেক মানুষ , যাদের কাউকেই চিনিনা।
চেনা-অচেনা প্রায় ৩৫/৪০ জন মানুষকে থাকতে হবে একটা ঘরের মধ্যে । রাতের বেলা দেখলাম, দূরে দেখা যাচ্ছে আগুনের লেলিহান শিখা । হাল্কা শব্দ ভেসে আসছে কান্না আর চিৎকারের। সবাই বলাবলি করছিল মিলিটারী জিঞ্জিরায় এসে পড়েছে । ওখানেও ওরা মানুষের ঘর বাড়ী পুরিয়ে দিচ্ছে , মানুষকে গুলি করে মারছে । রাতের বেলা একই ঘরের মধ্যে কেউ ছুরা কালাম পড়ছে কেউ অন্য ধর্মের কিছু জপ করছে । কে কার পিঠে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে , কে কার পায়ে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছে কোন ঠিক নাই । ঘরের মেঝেতে শুধুমাত্র পাটি বিছিয়ে ৩৫/৪০ জন মানুষ ঘুমাতে চেষ্টা করছে । ভোর হতে না হতেই সবাই একজন আরেক জনকে ডাকাডাকি । মিলিটারী চলে এসেছে । এখানে আর থাকা যাবেনা । তারাতারি বেরুতে হবে । কোথায় যাবো কোন পথে যাবো কিছু ঠিক করার মত কাউকে পাওয়া জাচ্ছে না । তারপরেও বেড়িয়ে পড়তে হলো ।এরই মধ্যে দেখা গেল একজন রক্তাক্ত মানুষ । হায় ! সে কি দৌড় । আমার হাতে একটা কাপড়ের পূটলি, আমার আরেক মামার হাতে একটা ব্যাগ জাতীয় কিছু তার মধ্য থেকে বেরিয়ে আছে বিশাল বড় শুটকি মাছের লেজ । মামা নাকি চিটাগাং থেকে আনিয়েছিলেন । মামী সেগুলো সাথে নিয়েছিলেন । আমার মামাত ভাই জুয়েল-এর হাতে একটা খাঁচা ভর্তি অনেক গুলো ডিম । ও ভয়ে কাঁপছিল । কাঁপছিল আর দৌড়াচ্ছিল। পড়ে গিয়ে বেশকিছু ডিম ভেঙ্গে গেলো । ও তাও ছারছেনা । ভাঙ্গা ডিমে ওর মাখামাখি অবস্থা দেখে শেষে ডিমের খঁচা ফেলে দেয়া হলো । চেনা অচেনা কতগুলি মানুষ একসাথে ছুটছি আমরা ।
এক পর্যায়ে একটা খালের পাশ দিয়ে দৌড়োচ্ছিলাম । এখন খাল পার হতে হবে । পানি কম মনে করে অনেকে কোমর পানি ভেঙ্গে হেটেই পার হতে চেষ্টা করলো । আমরা একটা নৌকা করে পার হবো । খালটা বেশ সরু । কিন্তু ধাক্কা-ধাক্কিতে আমার ছোট বোন সুইট খালের পারে পড়ে গেল । ছোট হলেও বেশ কথা বলতে পারে তখন সে । ও বলে উঠল – ‘আম্মা আমারে ফালাই দিয়াই যাইতেছেন গা ?’ আম্মাতো হায় হায় করে উঠল । বড় মামার একটা পোষা বিলিতি কুকুর ছিল , নাম- মায়া । কুকুরটা আমাদের সঙ্গেই ছিল । সেই কুকুরটা গিয়ে খপ করে সুইটের জামা কামড়ে ধরলো পানির কিনারায় । ওকে তুলে নিয়ে আবার চলা শুরু । কোন পথে কোথা যাচ্ছিলাম যেন তার ঠিক নাই, শুধু ছুটে চলা কোন নিরাপদ আশ্রয়ে।
তারপরেও বড় মামা ক্ষেতের পাশে বা বাড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ-জনকে জিজ্ঞাসা করে পথ চিনতে চেষ্টা করছিলেন । গ্রামের মানুষ জন কেউ কেউ আমাদেরকে ডেকে জানতে চাইছিল আমরা কোথা থেকে এসেছি , ঢাকা-র অবস্থা কি এসব । পথও বলে দিচ্ছিল কেউ কেউ। আমার মামাত বোন কাজল তখন মাত্র অল্প অল্প কথা বলে । বছর দের-দুয়েক বয়ষ হবে । হঠাৎ সে বায়না ধরলো , “আমি হাইট্টা হাইট্টা যাবো আমাকে নামাই দেও”। মামা-তো ভয়ানক বিরক্ত হলেন । প্রথমে ধমক দিলেন । পরে রাগে বল্লেন , এই ফালাইয়া দেতো এই বা...(একটা গালি )-রে । বেঁচে থাকলে এইরকম আরো মাইয়া হবে”।
অনেক পথ দৌড়িয়ে-হেটে এক সময় এসে পৌছালাম এক বিশাল নদীর পারে । এই পথে অনেক কম মানুষ । খুব সম্ভবত ওটা ছিল পদ্মা নদী । এক সময় নৌকা পাওয়া গেল । নৌকায় উঠে মনির মামা ওর শুটকির ব্যাগ ধপ করে ফেলতেই শুটকি মাছের লেজের আচরে আমার হাফ প্যান্টের নিচে রানের বেশ অনেক খানি ছিলে গেলো । আহ্ ! কি যে ব্যাথা লাগছিলো । কিছুক্ষন কান্না আর রাগে গজ গজ করতে করতে শুরু হলো আমাদের নৌকা ভ্রমন । দীর্ঘ সময় পরে এসে পৌছুলাম বাজারের মত একটা জায়গায় । একটা স্কুল ছিলো কাছেই । ওখানে এক আম গাছের নীচে মাটিতে বসলাম সবাই । মনে হয় জায়গাটার নাম ছিল সিরাজদিখান।
গাছতলায় বসে আমাদেরকে মুড়ি আর গুড় খাওয়ানো হলো , আর মনেহয় সাথে ঘোল ছিল ।
কিছুক্ষন গাছতলায় বিশ্রাম নিয়ে রিক্সায় করে রওয়ানা হলাম । এসে পৌছালাম ‘তালতলা’ নামের এক জায়গায়। ভাগ্য ভালো বলতে হবে । বিকেল গড়িয়ে আসলেও লঞ্চ পাওয়া গেলো।
লঞ্চে করে গেলাম আব্দুল্লাহ পুর । এখানে আসতেই সবাই একটু যেন ভার মুক্ত হলো । সেখানে কত মানুষ যে কত প্রশ্ন করছে । ওখান থেকে আবার রিক্সা নিয়ে শেষ পর্যন্ত এসে পৌছোলাম আমার নানা বাড়ী বিক্রমপুরের টংগীবাড়ী । তখন সন্ধার আঁধার নেমে এসেছে । ভয় আর কষ্টের এক বিশাল যাত্রাপথের যেন শেষ হলো ।
-By Kabir
No comments:
Post a Comment