[ কুখ্যাত জলদস্যু ব্ল্যাক বিয়ার্ডকে নিয়ে আমাদের এ পর্বটি সাজানো হবে । আজকে তার প্রথমাংশ পোষ্ট করা হল]
এক.
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ১৭১৭
শান্ত ক্যারিবীয় সাগরে ভাসছিল সওদাগরের জাহাজ। নাবিকরা খোশ গল্পে মত্ত। জাহাজে আছে ময়দা। ১২০ ব্যারেল ময়দা নিয়ে জাহাজটা ছেড়েছে হাভানা থেকে। পেছনে আরেকটা জাহাজ দেখা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। না ভয়ের কিছু নেই, পতাকা দেখেই বোঝা গেল ওটাও হাভানারই জাহাজ। আস্তে আস্তে দুটি জাহাজের মধ্যে দূরত্ব কমতে লাগলো। সওদাগরের জাহাজের সারেংও ভাবছিল, অনেক দিন পর নিজ দেশের লোকজনের সঙ্গে কথা তো হবে!
হঠাৎ কান ফাটানো শব্দে কেঁপে উঠলো বণিক জাহাজ। বোমার শব্দ। মুহুর্তেই উবে যায় নাবিকদের খোশ মেজাজ। মুহুর্মুহু বোমা পড়তে থাকে। নাবিকরা ডেকে উঠে আসে। বদলে গেছে ওই জাহাজটার পতাকা। সেখানে পত পত করে উড়ছে আরেকটি পতাকা। সবচেয়ে বয়স্ক, অভিজ্ঞ নাবিক আঁতকে উঠলো এই পতাকা দেখে। এটা যে জলদস্যু হর্নিগোল্ডের নিশানা!
কিছুক্ষণের মধ্যে আরেকটি ছোট জাহাজ এসে পাশে ভিড়ে। এই ছোট জাহাজটা বণিকরা আগে খেয়ালই করে নি। এই ছোট জাহাজে আছে নয়া দস্যু এডওয়ার্ড টেচ। সে হর্নিগোল্ডের শিষ্য। ভয়ঙ্কর দুঃসাহসের পরিচয় দিয়ে গুরুর মন জয় করেছে টেচ। পুরস্কার হিসেবে হর্নিগোল্ড তাকে এই ছোট জাহাজটা দিয়েছে।
টেচের জাহাজে দস্যুরা তলোয়ার আর কুড়াল ঘুরাচ্ছে। চিৎকার করে গালি দিচ্ছে বণিকদেরকে। গাদা বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়ছে একের পর এক। বণিক জাহাজের নাবিকদের ভয়ে প্রাণ উড়ে যায় যায়। এর মধ্যেই বিকট শব্দে আরও একটি বোমা বিস্ফোরণ হলো। বণিক জাহাজ পাগলের মতো ঘুরতে থাকে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে জাহাজ। একজন নাবিক দৌঁড়ে যায় সারেঙের ঘরে। রক্তে মাখামাখি সারা ঘর। সারেং মারা গেছে। এটাই ওদের কৌশল, ওরা প্রথমেই জাহাজের সারেংকে হত্যা করার চেষ্টা করে। দেখতে দেখতে দস্যুদের জাহাজ আরও কাছে চলে আসে। দস্যুরা লাফিয়ে পড়তে থাকে বণিকদের জাহাজে।
কিছুক্ষণ পর দস্যুদের জাহাজ থেকে বণিক জাহাজের ডেকে লাফিয়ে নামে লম্বা, চওড়া কাঁধের এক দস্যু। তার পায়ে হাঁটু পর্যন্ত উঁচু বুট। গায়ে লম্বা কোট। বুকের কাছে ঝোলানো অসংখ্য ছুরি আর ছোট ছোট তলোয়ার। হোলস্টারে ঝুলছে তিনটি পিস্তল। মাথায় ইউরোপিয়ান হ্যাট। শান্ত কিন্তু হিংস্র চোখে জ্বলজ্বল করছে নিষ্ঠুরতা। মুখে কালো লম্বা দাড়ি। সে দাড়িগুলোকে ছোট ছোট বেণী করে রেখেছে। ওর নাম এডওয়ার্ড টেচ। হর্নিগোল্ডের নিষ্ঠুরতা ছাপিয়ে গেছে টেচের চেহারায়। ওর ওই বেণী বাঁধা দাড়ির কারণেই লোকে ওর নাম দিয়েছে ব্ল্যাক বিয়ার্ড (কালো দাড়ি)।
নাবিকরা জানে আত্মসমর্পন করলে অন্তত প্রাণে বাঁচা যাবে। হয়তো জাহাজটাও বেঁচে যেতে পারে। কারণ ওরা কখনই বন্দীদেরকে হত্যা করে না। এর মধ্যেই জাহাজটা তছনছ করে ফেলেছে দস্যুরা। লুটে নিয়েছে তাদের সব দামি জিনিসপত্র, কিচ্ছু বাদ দেয় নি। এর পর দস্যুরা চলে যায় নিজেদের জাহাজে। চোখের পলকে উধাও হয়ে যায় জাহাজ দুটি।
দুই.
হর্নিগোল্ডের র্যাঞ্জার নামের বিশাল জাহাজের পাশে শান্তভাবে চলছে ব্ল্যাক বিয়ার্ডের ছোট্ট জাহাজ। দূর থেকে দেখে ওটাকে ডিঙ্গি নৌকা মনে হয়। কিছুদিন আগে ডাকাতি করা ময়দাগুলো ওরা শহরে নিয়ে কম দামে বেচে দিয়েছে। ভালই চলছে দস্যুদের সময়। ব্ল্যাকবিয়ার্ডের শিকারী চোখ খুঁজে ফেরে নতুন জাহাজ।
হর্নিগোল্ডের জাহাজের সারেং খবর দেয় দূরে একটা ছোট জাহাজ দেখা যাচ্ছে। ব্ল্যাকবিয়ার্ড সতর্ক হয়ে উঠে। জাহাজের পতাকা দেখিয়ে সঙ্কেত দেখায় যে ছেলেটা, সেই হাওয়ার্ডকেই নির্দেশ দেয় ওই জাহাজটি সম্পর্কে খোঁজ নিতে।
কিছুক্ষণ পর হাওয়ার্ড জানায়- জাহাজটা বারমুডা থেকে আসছে। আকারে বেশি বড় নয়। খুব বেশি হলে ১০০টি ব্যারেল থাকতে পারে ওখানে।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কাছে কোন জাহাজেরই নিস্তার নেই। ছোট বলে আমি কোন জাহাজকেই অবহেলা করি না।
হো হো করে তার বিশাল শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠে এডওয়ার্ড টেচ। হর্নিগোল্ডের কাছ থেকেও পাওয়া গেছে সবুজ সঙ্কেত।
হাওয়ার্ড জাহাজে বারমুডার পতাকা তুলে দেয়। গতি বাড়িয়ে দিয়েছে ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ডের র্যাঞ্জার। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের ছোট্ট জাহাজ। বারমুডার জাহাজের কাছাকাছি চলে এসেছে দস্যুরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা আক্রমণ করে বসে জাহাজটায়। তেমন কোন যুদ্ধই করতে হয় না ওদের। আসলে মালবাহী ওই বাণিজ্য জাহাজের নাবিকরা কোনো বাধাই দেয় নি। হাওয়ার্ডের ধারণাই সত্যি। জাহাজ থেকে একশ ব্যারেল ওয়াইন পেয়েছে ওরা।
ডাকাতি করা মাল নিয়ে ছুটে চলে র্যাঞ্জার। সঙ্গে নয়া দস্যু ব্ল্যাক বিয়ার্ড। দস্যুদের জাহাজে খুশির উৎসব। সারারাত গানবাজনার শব্দ শোনা যায়। অনেকে খুশিতে নাচছেও। জাহাজে মদের অভাব নেই। ডাকাতির বড় একটা অংশ পেয়েছে ক্যাপ্টেন হর্নিগোল্ড, তারপরের বড়ো ভাগটা পেয়েছে ব্ল্যাক বিয়ার্ড, আর বাকিটা অন্য নাবিকরা সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছে। এই দলে হর্নিগোল্ডের পরেই ব্ল্যাক বিয়ার্ডের স্থান। সে তার নিষ্ঠুরতা আর ভয়ঙ্কর চেহারা দিয়ে সবাইকে দমিয়ে রাখে। এভাবেই আনন্দের মধ্যে কেটে যায় আরও কয়েকদিন। এর মধ্যেই ডাকাতদের জন্য আসে আরেকটা সুখবর। ম্যাডেরিয়া থেকে সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ার চার্লস্টোনের দিকে আরেকটি বড় বাণিজ্য জাহাজ আসছে। পুরো জাহাজে খুশির বন্যা বয়ে যায়।
হর্নিগোল্ড আর ব্ল্যাকবিয়ার্ড দাবা খেলছিল। ব্ল্যাকবিয়ার্ড কিস্তির চালে আটকে দিয়েছে হর্নিগোল্ডের মন্ত্রীকে। কিন্তু এ নিশ্চিত পরাজয়ের মধ্যেও একটা হাসির ঝিলিক নেচে যায় হর্নিগোল্ডের ঠোঁটে। কারণ ওই বাণিজ্য জাহাজ। সে তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে এটা হবে অনেক বড়ো জাহাজ। আর এই জাহাজে স্বর্ণ, রূপার মত মহামূল্যবান ধনরত্ন নিশ্চয়ই আছে। হাসির অর্থটা ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কাছেও পরিস্কার। তার মুখেও হাসিটা সংক্রমিত হয়। করিৎকর্ম্মা সারেং কিন্তু জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে। এখন তাদের জাহাজ চলছে চার্লস্টোনের দিকে। কিছুক্ষণ পরে ব্ল্যাকবিয়ার্ড চলে যাবে তার নিজের জাহাজে। খুশিতে নিজের ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দেয় হর্নিগোল্ড।
সেপ্টেম্বর ১৭১৭।
চার্লস্টোনের জাহাজটা ডাকাতি করার পর কিছুদিন ধরে ওদের হাতে তেমন কোনো কাজ নেই। অলস হয়ে পড়েছে নাবিকরা। দস্যুরা গাদা বন্দুক পরিষ্কার করে, কেউ তলোয়ারে ধার দিয়ে সময় পার করে। কেউবা আবার সাগরে মাছ ধরে। সন্ধ্যা হলেই বসে গানের আসর। হর্নিগোল্ড আর ব্ল্যাকবিয়ার্ড বসে দাবা খেলতে। বেশির ভাগ দিনই ব্ল্যাক বিয়ার্ড জিতে যায়। মাঝ রাত পর্যন্ত চলে জুয়ার আসর।
একদিন সারেং খবর দেয় দূরে একটা জাহাজ দেখা গেছে। দস্যুদের মধ্যে চঞ্চলতা দেখা যায়। আড়মোড়া ভাঙে অলস দস্যুরা। হর্নিগোল্ডের চোখে সেই পরিচিত খুশির ঝিলিক। আর ব্ল্যাক বিয়ার্ডের মুখে ছড়িয়ে পরে ইবলিশের হাসি। সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেয় ক্যাপ্টেন হর্নিগোল্ড। নিজের ছোট জাহাজে চলে যায় ব্ল্যাক বিয়ার্ড, নিজের সঙ্গীদের প্রস্তুত হবার নির্দেশ দেয়। হাওয়ার্ড তৎপর হয় নিজ দায়িত্বে। সারেং ছোট জাহাজটিকে আস্তে আস্তে র্যাঞ্জারের আরও কাছে নিয়ে যায়। যেন সেখান থেকেই ক্যাপ্টেন হর্নিগোল্ডের নির্দেশ শুনতে পারে ব্ল্যাক বিয়ার্ড।
হাওয়ার্ড কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর নিয়ে হাজির হয় ব্ল্যাক বিয়ার্ডের সামনে- ক্যাপ্টেন, মনে হচ্ছে দস্যু জাহাজ।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- কীভাবে বুঝলে?
হাওয়ার্ড- এখনও কোন নিশানা লাগায় নি জাহাজটি। আমার মনে হয় অন্য জাহাজের পতাকা দেখেই ওরা পতাকা ওড়াবে।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- জাহাজটি কত বড়
হাওয়ার্ড- বেশি বড় নয়। মাঝারি। কিন্তু সে কথা কেন ক্যাপ্টেন? তুমি কি দস্যু জাহাজে ডাকাতি করতে চাচ্ছ?
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- আলী বাবা কী করেছিল? চোরের ওপর বাটপারি সব সময় লাভ জনক। আমাকে হর্নিগোল্ডের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড ডেকের কোণায় চলে আসে। চিৎকার দিয়ে ডাকে হর্নিগোল্ডকে
- ক্যাপ্টেন।
- বল টেচ
- সামনের জাহাজটা মনে হচ্ছে দস্যু জাহাজ
- তুমি কী ওটাতে হামলা করতে চাচ্ছ?
- আমার তাই ইচ্ছা। তুমি কী বল?
- তুমি একটা সাক্ষাৎ শয়তান। হা হা হা। আমার অমত নেই।
ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড এগিয়ে যায় সারেং এর ঘরের দিকে। চিৎকার করে নির্দেশ দেয়
- গতি বাড়াও সারেং
ব্ল্যাক বিয়ার্ডও একই নির্দেশ দেয় নিজের সারেংকে। শান্ত সমুদ্রে দুর্বার গতিতে ছুটে চলে র্যাঞ্জারের পাশে পাশে ছোট জাহাজ। দস্যুদের মধ্যে চাঞ্চল্য চলে এসেছে। সবাই কুড়াল, তলোয়ার আর গাদা বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত। চিৎকার করে নিজেদের চাঙা করে লুটেরারা। দেখতে দেখতে তারা আরও কাছে চলে আসে জাহাজটার।
ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন ওই জাহাজ টাকে থামার নির্দেশ দেয়। কিন্তু জাহাজ থেকে চ্যালেঞ্জ জানায় নতুন ডাকাতরা। বাধ্য হয়ে হর্নিগোল্ড নির্দেশ দেয়- ফায়ার।
এক ঝাক গাদা বন্দুকের গুলি আঘাত করে নতুন জাহাজটায়। যদিও জাহাজ থেকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল কিন্তু তাদের দিক থেকে প্রত্যুত্তরে কোন গুলি আসে না। ততক্ষণে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের জাহাজ ওই নতুন জাহাজের একেবারে গায়ের কাছে লেগে যায়। ব্ল্যাক বিয়ার্ড উঠে পড়ে জাহাজের ডেকে। ব্ল্যাক বিয়ার্ডকে দেখেই নতুন জাহাজের ডাকাতরা নিজেদের অস্ত্র নামিয়ে ফেলে। হর্নিগোল্ডও নিজের দস্যুদের গুলি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়।
ব্ল্যাক বিয়ার্ড- হা হা হা। তোমরা তো বেশ বীর পুরুষ দেখছি। চ্যালেঞ্জ করলে অথচ একটা গুলি পর্যন্ত ছুড়লে না। আবার আমি জাহাজে ওঠা মাত্র আত্মসমর্পণ করলে।
নতুন জাহাজের একজন দস্যু বলল- আমরা আমাদের ক্যাপ্টেনকে পছন্দ করি না। ওর সঙ্গে আমাদের ঝগড়া চলছিল। এর মধ্যেই তোমরা থামার নির্দেশ দিলে। আমরা বললাম তোমাদের সঙ্গে আলোচনা করি। দল বেধে যদি আমরা দস্যুতা করি তাহলে আমাদের সবারই সুবিধা কিন্তু আমাদের ক্যাপ্টেন চ্যালেঞ্জ করল। আমরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারি নি। তাই আমরা কোনো গুলি করি নি।
ব্ল্যাক বিয়ার্ড- বাহ্। কে তোমাদের হতভাগ্য ক্যাপ্টেন? নাম কী ওর?
দস্যু- ওর নাম স্টেড বনেট।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- স্টেড বনেট! কই সে।
এক সুঠাম দেহের যুবক এগিয়ে আসে।
- আমিই স্টেড বনেট।
- বাহ তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে ভাল লাগছে। বিদ্রুপ স্পষ্ট হয় ব্ল্যাকের কণ্ঠে।
- তা কবে থেকে জলদস্যুর খাতায় নাম লিখিয়েছ
- এ বছরের গোড়ায়।
- আগে কী করতে?
- সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলাম।
- বাহ্ রে সেনাবাহিনীর অফিসার! মাত্র সত্তরজন ক্রুই সামলাতে পরো না! এসো, তোমার সঙ্গে একটা সন্ধি করি।
- সন্ধি!
- হ্যাঁ। আমার মনে হয় এটা বরং তোমার জন্য অনেক ভালো প্রস্তাব। নইলে তোমার মৃত্যুই একমাত্র খোলা পথ জানো তো।
- কী ধরনের সন্ধি?
ব্ল্যাকবিয়ার্ড হর্নিগোল্ডের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে- ক্যাপ্টেন আমি এই জাহাজটা নিতে চাই।
হর্নিগোল্ড- নিয়ে নাও। ওটা তো তোমারই।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন। শোন স্টেড, তোমার এসবে কাজ নেই। তুমি আমার জাহাজে অতিথির মতো থাকো। আর তোমার এই জাহাজের দায়িত্ব এখন থেকে আমার।
স্টেড- আমি একটু ভাবতে চাই।
ব্ল্যাক বিয়ার্ড- আমি কখনও আমার শত্রুকে ভাবার জন্য প্রস্তাব দেই না। বরং আমি দেই সিদ্ধান্ত। তোমার হাতে কোনো বিকল্প নেই।। অবশ্য যদি তুমি মরতে চাও সেটা আলাদা কথা।
স্টেড বুঝতে পারে তার আসলে বলার আর কিছুই নেই। বরং ব্ল্যাকবিয়ার্ডের প্রস্তাব মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
চার.
নভেম্বর, ১৭১৭।
নিউ প্রভিডেন্স।
১৮ শতকের শুরুর দিকে হেনরি জেনিংস আর তার চ্যালারা তাদের ঘাটি হিসেবে নিউ প্রভিডেন্স ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। হেনরি জেনিংসও একসময় প্রাইভেটিয়ার ছিল। পরে জলদস্যু হয়। নিউ প্রভিডেন্স ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় কারণ একে তো দ্বীপটা ছিল প্রায় শুণ্য তার ওপর ফ্লোরিডা স্ট্রেইটস থেকে সহজে এখানে পৌছানো যেত। নিউ প্রভিডেন্সের পোতাশ্রয়ে খুব সহজে শত শত জাহাজ রাখা যায়। কিন্তু এখানকার পানি এত অগভীর যে রাষ্ট্রীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ঢুকতে পারে না। এ সুযোগটা যারা কাজিয়ে লাগিয়েছিল তাদের মধ্যে হর্নিগোল্ডও একজন। পরে সম্ভবত আটরেচট চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই ১৭১৬ সালে টেচ জ্যামাইকা ছেড়ে এখানে এসে হর্নিগোল্ডের দলে ভিড়ে যায়। আসলে এটা, যে সব প্রাইভেটিয়াররা পরে জলদস্যু হয়ে গিয়েছিল তাদের সবার জন্যই নিরাপদ আস্তানা হয়ে উঠেছিল।
ক্যাপ্টেন হর্নিগোল্ডের দলে এখন তিনটি জাহাজ। তার নিজের র্যাঞ্জার, ব্ল্যাকবিয়ার্ডের ছোট্ট জাহাজ, আর স্টেড বনেটের কাছ থেকে পাওয়া নতুন জাহাজ। নতুন এই জাহাজটার নতুন নাম দিয়েছে ব্ল্যাকবিয়ার্ড। জাহাজের নাম রাখা হয়েছে রিভেঞ্জ বা প্রতিশোধ। রিভেঞ্জেই চলছে আজকের রুদ্ধদ্বার বৈঠক। দস্যুরা অভিযোগ করেছে ক্যাপ্টেন হর্নিগোল্ড ব্রিটিশ জাহাজ ছেড়ে দেয়। অথচ এসব জাহাজে থাকে অনেক মনি মাণিক্য। সুতরাং হর্নিগোল্ডকে পদ থেকে ডিমোশন দিতে হবে। বৈঠকে কে কে আছে কেউ জানে না। বাইরে দুই একজন অপেক্ষা করছে বৈঠকের ফলাফল জানার জন্য। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে একজন ঘোষক বাইরে বেরিয়ে এল।
- ক্যাপ্টেন হর্নিগোল্ডকে বর্তমান পদ থেকে নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
চিৎকার করে বলে ঘোষক। এর মধ্যেই ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড নিজেও বাইরে বের হয়ে আসে। সে বলে-
- আসলে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি অবসর নেব। চলে যাব এখান থেকে। অবশ্যই যাবার সময় আমার র্যাঞ্জার আর একটা ছোট জাহাজ নিয়ে যাব।
দস্যুদের মধ্যে গুঞ্জন দেখা দেয়। কে হবে তাহলে পরবর্তী সর্দ্দার? আর হর্নিগোল্ড সত্যিই তাহলে এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে?
পাঁচ
নভেম্বর ২৮, ১৭১৭।
স্বাভাবিকভাবেই ব্ল্যাকবিয়ার্ড সর্দার হয়েছে। খবর এসেছে হর্নিগোল্ড বাহামার গভর্নর উডস রোজার্সের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা নিয়েছে। সুতরাং এখন ব্ল্যাক বিয়ার্ড আর হর্নিগোল্ডের রাস্তা আলাদা। নিজের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে ব্ল্যাক বিয়ার্ডকে আরও অনেক কঠোর হতে হবে। ডেকে বসে এসবই ভাবছিল এডওয়ার্ড টেচ।
এ সময় হাওয়ার্ড এসে খবর দেয়-
-সেইন্ট ভিনসেন্ট উপকূলের কাছে একটা ফরাসী বাণিজ্য জাহাজ এসেছে।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- অতএব, দুটি জাহাজ নিয়ে চলো সে দিকে গাধা।
ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্ত মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে দস্যুদের মধ্যে। সবাই প্রস্তুত। দুটি জাহাজ নিয়ে সেইন্ট ভিনসেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায় দস্যুদল। দেখতে দেখতে দুরন্ত জাহাজ দুটি পৌঁছে যায় সেখানে। হাওয়ার্ডের খবর ছিল অভ্রান্ত। অতর্কিতে তারা জাহাজটিতে আক্রমণ করে। যুদ্ধে কুলিয়ে উঠতে পারে না বণিক জাহাজের ক্যাপ্টেন। ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে সে। জাহাজটা ছিল দাসে বোঝাই। তাদের মাঝখান থেকে শক্তিশালী কয়েকজনকে নিজের দলে ভিড়িয়ে নেয় টেচ। আর বাকি সবাইকে নির্জন দ্বীপে ফেলে রেখে চলে জাহাজটি নিয়ে। জাহাজটির নাম ছিল লা কনকর্ড। পরে টেচ এর সংস্কার করে নাম দেয় কুইন এন’স রিভেঞ্জ। জাহাজে সে চল্লিশটি বন্দুক বসায়।
এর পর আর দুর্ধর্ষ টেচ থেমে থাকে নি। একের পর এক আক্রমণ করে চলে বণিক জাহাজ। এর মধ্যে সে গ্রেট এলেন নামের আরেকটি জাহাজে আক্রমণ করে। মালামাল সব লুটে নিয়ে আগুন ধরিয়ে ডুবিয়ে দেয় জাহাজটি।
ছয়.
লেফটেন্যান্ট মেইনার্ডের জাহাজ।
মুখ খুলে লেফটেন্যান্ট রবার্ট মেইনার্ড- ব্ল্যাক বিয়ার্ডকে গ্রেপ্তার করার জন্য আমাকে ডেকেছেন ভার্জিনিয়ার গভর্নর আলেকজান্ডার স্পটসউড।
রবার্ট মেইনার্ড যেমন দুঃসাহসী তেমনি অভিজ্ঞ। রোজার আর ফ্রায়ার মিল তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাদের চোখ সমুদ্রের দিকে। শান্ত গতিতে ছুটে চলেছে তাদের জাহাজ। দুইদিন ধরে চলছে তাদের জাহাজ। আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখানে চলে গিয়েছিল ওরা একটা জলদস্যু দলকে ধাওয়া করে। তাদের বারোটা বাজানোর পরই একটা সরকারি খবর এসেছে মেইনার্ডের কাছে। কিন্তু এ দুইদিনে একবারও মুখ খোলে নি সে। এটাই তার স্বভাব। আজও হয়তো তেমন কিছুই বলবে না। তবে নাবিকরা বুঝতে পারল কেন তারা ভার্জিনিয়াতে যাচ্ছে।
রোজার- ব্ল্যাক বিয়ার্ড মানে এ সময়ের দুনিয়া কাঁপানো জলদস্যু!
রগচটা হিসেবে বেশ কুখ্যাতি আছে রোজারের। সবাই তাকে বেশ সমঝে চলে। এমন কি প্রিয় বন্ধু ফ্রায়ার মিল পর্যন্ত মাঝে মাঝে তাকে সমীহই করে। ও যখন কথা বলে তখন জাহাজে যেন ভূমিকম্প হয়।
ফ্রায়ার মিল- হ্যা, ওর আসল নাম এডওয়ার্ড টেচ।
ফ্রায়ার মিল ইতিহাসে পণ্ডিত। যে কোনো ঘটনার সাল তারিখ সব তার মুখস্থ। তার এই জ্ঞানের জন্যই অন্য নাবিকরা তাকে ডাকে ফ্রায়ার।
মেইনার্ড- অনেকে কিন্তু বলে ওর নাম এডওয়ার্ড ডারমন্ড।
ফ্রায়ার মিল- হুম কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। ব্রিটেনের ব্রিস্টলে, সম্ভবত ১৬৮০ সালের দিকে একটা ধনী পরিবারে ওর জন্ম। ১৬৯৯ সালের দিকে একটা বাণিজ্য জাহাজে আরও সঠিক ভাবে বললে সম্ভবত এক দাস জাহাজে করে ও ক্যারিবিয়াতে এসেছিল। ক্যারিবিয়াতে যে দ্বীপে ও নামে, তার নাম জ্যামাইকা।
রোজার বাধা দিয়ে বলে- মিল তোমার এই সাল তারিখের ক্যাচক্যাচানি বন্ধ করবে! এমনিতেই মেজাজ খিচড়ে আছে। তোমার এই সাল তারিখ শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে।
ফ্রায়ার মিল- আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আর সাল তারিখ বলব না। আঠারোশ শতাব্দীতে..
রোজার- মিল! আমরা জানি এটা আঠারোশ শতাব্দী।
সবাই হেসে উঠে।
মিল- দুঃখিত। লেখক জনসন লিখেছেন টেচ মানে ব্ল্যাক বিয়ার্ড রাণী এনের যুদ্ধের সময় জ্যামাইকাতে একটা প্রাইভেটিয়ারে নাবিক হিসেবে কাজ করতো। রাণী এন সেই টেচের প্রাইভেটিয়ারকে ফরাসী আর স্প্যানিশ জাহাজ আক্রমণ করার আর লুণ্ঠিত মালামাল নিজের কাছে রাখার অনুমতি দিয়েছিলেন। এটা স্প্যানিশ বিপ্লবের সময়কার ঘটনা।
মেইনার্ড- পরে যুদ্ধ শেষ হলে টেচ হয়ে ওঠে এক অভিজ্ঞ জলদস্যু। প্রাইভেটিয়ারে থাকাকালীনই সে ডাকাতিতে অনেক দক্ষ হয়ে উঠেছিল। সে আর ভাল মানুষ হয় নি, ভিড়ে যায় ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ডের দলে।
রোজার- ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড! মানে নিউ প্রভিডেন্সের সেই কুখ্যাত ডাকাত! কিছুদিন আগে যে সাধারণ ক্ষমা গ্রহণ করল?
মিল- হ্যা ১৭১৮ সালের জুন মাসে হাভানার গভর্নর উডস রজার্সের কাছে।
রোজার- মিল আমি কিন্তু এবারে সত্যি ক্ষেপে যাবো।
মিল- আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত রোজার। কিন্তু সাল তারিখ ছাড়া আমি কথাই বলতে পারি না তাতো তুমি জানোই। যা হোক, সম্ভবত আটরেচট চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই টেচ জ্যামাইকা ছেড়ে নিউ প্রভিডেন্সে চলে আসে। আসলে এটা যে সব প্রাইভেটিয়াররা পরে জলদস্যু হয়ে গিয়েছিল তাদের সবার জন্যই নিরাপদ আস্তানা হয়ে উঠেছিল। সম্ভবত ১৭১৬ সালে টেচ হর্নিগোল্ড এর দলে যোগ দেয়।
রোজার- বাচাল তোতাপাখি মিল, আমি তোমাকে কিন্তু জ্যান্ত খেয়ে ফেলব।
মিল থতমত খায়।
মেইনার্ড- আচ্ছা থামো তোমরা। একটু ওয়াইন গেলা যাক।
মিল- হ্যা এটা কিন্তু ভাল প্রস্তাব। আঠারোশ...
মেইনার্ড- মিল!
মিল বুঝতে পারে এর পরে আরও কথা বললে খবর আছে।(1 to 3)
এক.
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ১৭১৭
শান্ত ক্যারিবীয় সাগরে ভাসছিল সওদাগরের জাহাজ। নাবিকরা খোশ গল্পে মত্ত। জাহাজে আছে ময়দা। ১২০ ব্যারেল ময়দা নিয়ে জাহাজটা ছেড়েছে হাভানা থেকে। পেছনে আরেকটা জাহাজ দেখা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। না ভয়ের কিছু নেই, পতাকা দেখেই বোঝা গেল ওটাও হাভানারই জাহাজ। আস্তে আস্তে দুটি জাহাজের মধ্যে দূরত্ব কমতে লাগলো। সওদাগরের জাহাজের সারেংও ভাবছিল, অনেক দিন পর নিজ দেশের লোকজনের সঙ্গে কথা তো হবে!
হঠাৎ কান ফাটানো শব্দে কেঁপে উঠলো বণিক জাহাজ। বোমার শব্দ। মুহুর্তেই উবে যায় নাবিকদের খোশ মেজাজ। মুহুর্মুহু বোমা পড়তে থাকে। নাবিকরা ডেকে উঠে আসে। বদলে গেছে ওই জাহাজটার পতাকা। সেখানে পত পত করে উড়ছে আরেকটি পতাকা। সবচেয়ে বয়স্ক, অভিজ্ঞ নাবিক আঁতকে উঠলো এই পতাকা দেখে। এটা যে জলদস্যু হর্নিগোল্ডের নিশানা!
কিছুক্ষণের মধ্যে আরেকটি ছোট জাহাজ এসে পাশে ভিড়ে। এই ছোট জাহাজটা বণিকরা আগে খেয়ালই করে নি। এই ছোট জাহাজে আছে নয়া দস্যু এডওয়ার্ড টেচ। সে হর্নিগোল্ডের শিষ্য। ভয়ঙ্কর দুঃসাহসের পরিচয় দিয়ে গুরুর মন জয় করেছে টেচ। পুরস্কার হিসেবে হর্নিগোল্ড তাকে এই ছোট জাহাজটা দিয়েছে।
টেচের জাহাজে দস্যুরা তলোয়ার আর কুড়াল ঘুরাচ্ছে। চিৎকার করে গালি দিচ্ছে বণিকদেরকে। গাদা বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়ছে একের পর এক। বণিক জাহাজের নাবিকদের ভয়ে প্রাণ উড়ে যায় যায়। এর মধ্যেই বিকট শব্দে আরও একটি বোমা বিস্ফোরণ হলো। বণিক জাহাজ পাগলের মতো ঘুরতে থাকে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে জাহাজ। একজন নাবিক দৌঁড়ে যায় সারেঙের ঘরে। রক্তে মাখামাখি সারা ঘর। সারেং মারা গেছে। এটাই ওদের কৌশল, ওরা প্রথমেই জাহাজের সারেংকে হত্যা করার চেষ্টা করে। দেখতে দেখতে দস্যুদের জাহাজ আরও কাছে চলে আসে। দস্যুরা লাফিয়ে পড়তে থাকে বণিকদের জাহাজে।
কিছুক্ষণ পর দস্যুদের জাহাজ থেকে বণিক জাহাজের ডেকে লাফিয়ে নামে লম্বা, চওড়া কাঁধের এক দস্যু। তার পায়ে হাঁটু পর্যন্ত উঁচু বুট। গায়ে লম্বা কোট। বুকের কাছে ঝোলানো অসংখ্য ছুরি আর ছোট ছোট তলোয়ার। হোলস্টারে ঝুলছে তিনটি পিস্তল। মাথায় ইউরোপিয়ান হ্যাট। শান্ত কিন্তু হিংস্র চোখে জ্বলজ্বল করছে নিষ্ঠুরতা। মুখে কালো লম্বা দাড়ি। সে দাড়িগুলোকে ছোট ছোট বেণী করে রেখেছে। ওর নাম এডওয়ার্ড টেচ। হর্নিগোল্ডের নিষ্ঠুরতা ছাপিয়ে গেছে টেচের চেহারায়। ওর ওই বেণী বাঁধা দাড়ির কারণেই লোকে ওর নাম দিয়েছে ব্ল্যাক বিয়ার্ড (কালো দাড়ি)।
নাবিকরা জানে আত্মসমর্পন করলে অন্তত প্রাণে বাঁচা যাবে। হয়তো জাহাজটাও বেঁচে যেতে পারে। কারণ ওরা কখনই বন্দীদেরকে হত্যা করে না। এর মধ্যেই জাহাজটা তছনছ করে ফেলেছে দস্যুরা। লুটে নিয়েছে তাদের সব দামি জিনিসপত্র, কিচ্ছু বাদ দেয় নি। এর পর দস্যুরা চলে যায় নিজেদের জাহাজে। চোখের পলকে উধাও হয়ে যায় জাহাজ দুটি।
দুই.
হর্নিগোল্ডের র্যাঞ্জার নামের বিশাল জাহাজের পাশে শান্তভাবে চলছে ব্ল্যাক বিয়ার্ডের ছোট্ট জাহাজ। দূর থেকে দেখে ওটাকে ডিঙ্গি নৌকা মনে হয়। কিছুদিন আগে ডাকাতি করা ময়দাগুলো ওরা শহরে নিয়ে কম দামে বেচে দিয়েছে। ভালই চলছে দস্যুদের সময়। ব্ল্যাকবিয়ার্ডের শিকারী চোখ খুঁজে ফেরে নতুন জাহাজ।
হর্নিগোল্ডের জাহাজের সারেং খবর দেয় দূরে একটা ছোট জাহাজ দেখা যাচ্ছে। ব্ল্যাকবিয়ার্ড সতর্ক হয়ে উঠে। জাহাজের পতাকা দেখিয়ে সঙ্কেত দেখায় যে ছেলেটা, সেই হাওয়ার্ডকেই নির্দেশ দেয় ওই জাহাজটি সম্পর্কে খোঁজ নিতে।
কিছুক্ষণ পর হাওয়ার্ড জানায়- জাহাজটা বারমুডা থেকে আসছে। আকারে বেশি বড় নয়। খুব বেশি হলে ১০০টি ব্যারেল থাকতে পারে ওখানে।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কাছে কোন জাহাজেরই নিস্তার নেই। ছোট বলে আমি কোন জাহাজকেই অবহেলা করি না।
হো হো করে তার বিশাল শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠে এডওয়ার্ড টেচ। হর্নিগোল্ডের কাছ থেকেও পাওয়া গেছে সবুজ সঙ্কেত।
হাওয়ার্ড জাহাজে বারমুডার পতাকা তুলে দেয়। গতি বাড়িয়ে দিয়েছে ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ডের র্যাঞ্জার। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের ছোট্ট জাহাজ। বারমুডার জাহাজের কাছাকাছি চলে এসেছে দস্যুরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা আক্রমণ করে বসে জাহাজটায়। তেমন কোন যুদ্ধই করতে হয় না ওদের। আসলে মালবাহী ওই বাণিজ্য জাহাজের নাবিকরা কোনো বাধাই দেয় নি। হাওয়ার্ডের ধারণাই সত্যি। জাহাজ থেকে একশ ব্যারেল ওয়াইন পেয়েছে ওরা।
ডাকাতি করা মাল নিয়ে ছুটে চলে র্যাঞ্জার। সঙ্গে নয়া দস্যু ব্ল্যাক বিয়ার্ড। দস্যুদের জাহাজে খুশির উৎসব। সারারাত গানবাজনার শব্দ শোনা যায়। অনেকে খুশিতে নাচছেও। জাহাজে মদের অভাব নেই। ডাকাতির বড় একটা অংশ পেয়েছে ক্যাপ্টেন হর্নিগোল্ড, তারপরের বড়ো ভাগটা পেয়েছে ব্ল্যাক বিয়ার্ড, আর বাকিটা অন্য নাবিকরা সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছে। এই দলে হর্নিগোল্ডের পরেই ব্ল্যাক বিয়ার্ডের স্থান। সে তার নিষ্ঠুরতা আর ভয়ঙ্কর চেহারা দিয়ে সবাইকে দমিয়ে রাখে। এভাবেই আনন্দের মধ্যে কেটে যায় আরও কয়েকদিন। এর মধ্যেই ডাকাতদের জন্য আসে আরেকটা সুখবর। ম্যাডেরিয়া থেকে সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ার চার্লস্টোনের দিকে আরেকটি বড় বাণিজ্য জাহাজ আসছে। পুরো জাহাজে খুশির বন্যা বয়ে যায়।
হর্নিগোল্ড আর ব্ল্যাকবিয়ার্ড দাবা খেলছিল। ব্ল্যাকবিয়ার্ড কিস্তির চালে আটকে দিয়েছে হর্নিগোল্ডের মন্ত্রীকে। কিন্তু এ নিশ্চিত পরাজয়ের মধ্যেও একটা হাসির ঝিলিক নেচে যায় হর্নিগোল্ডের ঠোঁটে। কারণ ওই বাণিজ্য জাহাজ। সে তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে এটা হবে অনেক বড়ো জাহাজ। আর এই জাহাজে স্বর্ণ, রূপার মত মহামূল্যবান ধনরত্ন নিশ্চয়ই আছে। হাসির অর্থটা ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কাছেও পরিস্কার। তার মুখেও হাসিটা সংক্রমিত হয়। করিৎকর্ম্মা সারেং কিন্তু জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে। এখন তাদের জাহাজ চলছে চার্লস্টোনের দিকে। কিছুক্ষণ পরে ব্ল্যাকবিয়ার্ড চলে যাবে তার নিজের জাহাজে। খুশিতে নিজের ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দেয় হর্নিগোল্ড।
সেপ্টেম্বর ১৭১৭।
চার্লস্টোনের জাহাজটা ডাকাতি করার পর কিছুদিন ধরে ওদের হাতে তেমন কোনো কাজ নেই। অলস হয়ে পড়েছে নাবিকরা। দস্যুরা গাদা বন্দুক পরিষ্কার করে, কেউ তলোয়ারে ধার দিয়ে সময় পার করে। কেউবা আবার সাগরে মাছ ধরে। সন্ধ্যা হলেই বসে গানের আসর। হর্নিগোল্ড আর ব্ল্যাকবিয়ার্ড বসে দাবা খেলতে। বেশির ভাগ দিনই ব্ল্যাক বিয়ার্ড জিতে যায়। মাঝ রাত পর্যন্ত চলে জুয়ার আসর।
একদিন সারেং খবর দেয় দূরে একটা জাহাজ দেখা গেছে। দস্যুদের মধ্যে চঞ্চলতা দেখা যায়। আড়মোড়া ভাঙে অলস দস্যুরা। হর্নিগোল্ডের চোখে সেই পরিচিত খুশির ঝিলিক। আর ব্ল্যাক বিয়ার্ডের মুখে ছড়িয়ে পরে ইবলিশের হাসি। সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেয় ক্যাপ্টেন হর্নিগোল্ড। নিজের ছোট জাহাজে চলে যায় ব্ল্যাক বিয়ার্ড, নিজের সঙ্গীদের প্রস্তুত হবার নির্দেশ দেয়। হাওয়ার্ড তৎপর হয় নিজ দায়িত্বে। সারেং ছোট জাহাজটিকে আস্তে আস্তে র্যাঞ্জারের আরও কাছে নিয়ে যায়। যেন সেখান থেকেই ক্যাপ্টেন হর্নিগোল্ডের নির্দেশ শুনতে পারে ব্ল্যাক বিয়ার্ড।
হাওয়ার্ড কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর নিয়ে হাজির হয় ব্ল্যাক বিয়ার্ডের সামনে- ক্যাপ্টেন, মনে হচ্ছে দস্যু জাহাজ।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- কীভাবে বুঝলে?
হাওয়ার্ড- এখনও কোন নিশানা লাগায় নি জাহাজটি। আমার মনে হয় অন্য জাহাজের পতাকা দেখেই ওরা পতাকা ওড়াবে।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- জাহাজটি কত বড়
হাওয়ার্ড- বেশি বড় নয়। মাঝারি। কিন্তু সে কথা কেন ক্যাপ্টেন? তুমি কি দস্যু জাহাজে ডাকাতি করতে চাচ্ছ?
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- আলী বাবা কী করেছিল? চোরের ওপর বাটপারি সব সময় লাভ জনক। আমাকে হর্নিগোল্ডের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড ডেকের কোণায় চলে আসে। চিৎকার দিয়ে ডাকে হর্নিগোল্ডকে
- ক্যাপ্টেন।
- বল টেচ
- সামনের জাহাজটা মনে হচ্ছে দস্যু জাহাজ
- তুমি কী ওটাতে হামলা করতে চাচ্ছ?
- আমার তাই ইচ্ছা। তুমি কী বল?
- তুমি একটা সাক্ষাৎ শয়তান। হা হা হা। আমার অমত নেই।
ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড এগিয়ে যায় সারেং এর ঘরের দিকে। চিৎকার করে নির্দেশ দেয়
- গতি বাড়াও সারেং
ব্ল্যাক বিয়ার্ডও একই নির্দেশ দেয় নিজের সারেংকে। শান্ত সমুদ্রে দুর্বার গতিতে ছুটে চলে র্যাঞ্জারের পাশে পাশে ছোট জাহাজ। দস্যুদের মধ্যে চাঞ্চল্য চলে এসেছে। সবাই কুড়াল, তলোয়ার আর গাদা বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত। চিৎকার করে নিজেদের চাঙা করে লুটেরারা। দেখতে দেখতে তারা আরও কাছে চলে আসে জাহাজটার।
ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন ওই জাহাজ টাকে থামার নির্দেশ দেয়। কিন্তু জাহাজ থেকে চ্যালেঞ্জ জানায় নতুন ডাকাতরা। বাধ্য হয়ে হর্নিগোল্ড নির্দেশ দেয়- ফায়ার।
এক ঝাক গাদা বন্দুকের গুলি আঘাত করে নতুন জাহাজটায়। যদিও জাহাজ থেকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল কিন্তু তাদের দিক থেকে প্রত্যুত্তরে কোন গুলি আসে না। ততক্ষণে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের জাহাজ ওই নতুন জাহাজের একেবারে গায়ের কাছে লেগে যায়। ব্ল্যাক বিয়ার্ড উঠে পড়ে জাহাজের ডেকে। ব্ল্যাক বিয়ার্ডকে দেখেই নতুন জাহাজের ডাকাতরা নিজেদের অস্ত্র নামিয়ে ফেলে। হর্নিগোল্ডও নিজের দস্যুদের গুলি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়।
ব্ল্যাক বিয়ার্ড- হা হা হা। তোমরা তো বেশ বীর পুরুষ দেখছি। চ্যালেঞ্জ করলে অথচ একটা গুলি পর্যন্ত ছুড়লে না। আবার আমি জাহাজে ওঠা মাত্র আত্মসমর্পণ করলে।
নতুন জাহাজের একজন দস্যু বলল- আমরা আমাদের ক্যাপ্টেনকে পছন্দ করি না। ওর সঙ্গে আমাদের ঝগড়া চলছিল। এর মধ্যেই তোমরা থামার নির্দেশ দিলে। আমরা বললাম তোমাদের সঙ্গে আলোচনা করি। দল বেধে যদি আমরা দস্যুতা করি তাহলে আমাদের সবারই সুবিধা কিন্তু আমাদের ক্যাপ্টেন চ্যালেঞ্জ করল। আমরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারি নি। তাই আমরা কোনো গুলি করি নি।
ব্ল্যাক বিয়ার্ড- বাহ্। কে তোমাদের হতভাগ্য ক্যাপ্টেন? নাম কী ওর?
দস্যু- ওর নাম স্টেড বনেট।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- স্টেড বনেট! কই সে।
এক সুঠাম দেহের যুবক এগিয়ে আসে।
- আমিই স্টেড বনেট।
- বাহ তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে ভাল লাগছে। বিদ্রুপ স্পষ্ট হয় ব্ল্যাকের কণ্ঠে।
- তা কবে থেকে জলদস্যুর খাতায় নাম লিখিয়েছ
- এ বছরের গোড়ায়।
- আগে কী করতে?
- সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলাম।
- বাহ্ রে সেনাবাহিনীর অফিসার! মাত্র সত্তরজন ক্রুই সামলাতে পরো না! এসো, তোমার সঙ্গে একটা সন্ধি করি।
- সন্ধি!
- হ্যাঁ। আমার মনে হয় এটা বরং তোমার জন্য অনেক ভালো প্রস্তাব। নইলে তোমার মৃত্যুই একমাত্র খোলা পথ জানো তো।
- কী ধরনের সন্ধি?
ব্ল্যাকবিয়ার্ড হর্নিগোল্ডের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে- ক্যাপ্টেন আমি এই জাহাজটা নিতে চাই।
হর্নিগোল্ড- নিয়ে নাও। ওটা তো তোমারই।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন। শোন স্টেড, তোমার এসবে কাজ নেই। তুমি আমার জাহাজে অতিথির মতো থাকো। আর তোমার এই জাহাজের দায়িত্ব এখন থেকে আমার।
স্টেড- আমি একটু ভাবতে চাই।
ব্ল্যাক বিয়ার্ড- আমি কখনও আমার শত্রুকে ভাবার জন্য প্রস্তাব দেই না। বরং আমি দেই সিদ্ধান্ত। তোমার হাতে কোনো বিকল্প নেই।। অবশ্য যদি তুমি মরতে চাও সেটা আলাদা কথা।
স্টেড বুঝতে পারে তার আসলে বলার আর কিছুই নেই। বরং ব্ল্যাকবিয়ার্ডের প্রস্তাব মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
চার.
নভেম্বর, ১৭১৭।
নিউ প্রভিডেন্স।
১৮ শতকের শুরুর দিকে হেনরি জেনিংস আর তার চ্যালারা তাদের ঘাটি হিসেবে নিউ প্রভিডেন্স ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। হেনরি জেনিংসও একসময় প্রাইভেটিয়ার ছিল। পরে জলদস্যু হয়। নিউ প্রভিডেন্স ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় কারণ একে তো দ্বীপটা ছিল প্রায় শুণ্য তার ওপর ফ্লোরিডা স্ট্রেইটস থেকে সহজে এখানে পৌছানো যেত। নিউ প্রভিডেন্সের পোতাশ্রয়ে খুব সহজে শত শত জাহাজ রাখা যায়। কিন্তু এখানকার পানি এত অগভীর যে রাষ্ট্রীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ঢুকতে পারে না। এ সুযোগটা যারা কাজিয়ে লাগিয়েছিল তাদের মধ্যে হর্নিগোল্ডও একজন। পরে সম্ভবত আটরেচট চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই ১৭১৬ সালে টেচ জ্যামাইকা ছেড়ে এখানে এসে হর্নিগোল্ডের দলে ভিড়ে যায়। আসলে এটা, যে সব প্রাইভেটিয়াররা পরে জলদস্যু হয়ে গিয়েছিল তাদের সবার জন্যই নিরাপদ আস্তানা হয়ে উঠেছিল।
ক্যাপ্টেন হর্নিগোল্ডের দলে এখন তিনটি জাহাজ। তার নিজের র্যাঞ্জার, ব্ল্যাকবিয়ার্ডের ছোট্ট জাহাজ, আর স্টেড বনেটের কাছ থেকে পাওয়া নতুন জাহাজ। নতুন এই জাহাজটার নতুন নাম দিয়েছে ব্ল্যাকবিয়ার্ড। জাহাজের নাম রাখা হয়েছে রিভেঞ্জ বা প্রতিশোধ। রিভেঞ্জেই চলছে আজকের রুদ্ধদ্বার বৈঠক। দস্যুরা অভিযোগ করেছে ক্যাপ্টেন হর্নিগোল্ড ব্রিটিশ জাহাজ ছেড়ে দেয়। অথচ এসব জাহাজে থাকে অনেক মনি মাণিক্য। সুতরাং হর্নিগোল্ডকে পদ থেকে ডিমোশন দিতে হবে। বৈঠকে কে কে আছে কেউ জানে না। বাইরে দুই একজন অপেক্ষা করছে বৈঠকের ফলাফল জানার জন্য। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে একজন ঘোষক বাইরে বেরিয়ে এল।
- ক্যাপ্টেন হর্নিগোল্ডকে বর্তমান পদ থেকে নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
চিৎকার করে বলে ঘোষক। এর মধ্যেই ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড নিজেও বাইরে বের হয়ে আসে। সে বলে-
- আসলে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি অবসর নেব। চলে যাব এখান থেকে। অবশ্যই যাবার সময় আমার র্যাঞ্জার আর একটা ছোট জাহাজ নিয়ে যাব।
দস্যুদের মধ্যে গুঞ্জন দেখা দেয়। কে হবে তাহলে পরবর্তী সর্দ্দার? আর হর্নিগোল্ড সত্যিই তাহলে এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে?
পাঁচ
নভেম্বর ২৮, ১৭১৭।
স্বাভাবিকভাবেই ব্ল্যাকবিয়ার্ড সর্দার হয়েছে। খবর এসেছে হর্নিগোল্ড বাহামার গভর্নর উডস রোজার্সের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা নিয়েছে। সুতরাং এখন ব্ল্যাক বিয়ার্ড আর হর্নিগোল্ডের রাস্তা আলাদা। নিজের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে ব্ল্যাক বিয়ার্ডকে আরও অনেক কঠোর হতে হবে। ডেকে বসে এসবই ভাবছিল এডওয়ার্ড টেচ।
এ সময় হাওয়ার্ড এসে খবর দেয়-
-সেইন্ট ভিনসেন্ট উপকূলের কাছে একটা ফরাসী বাণিজ্য জাহাজ এসেছে।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড- অতএব, দুটি জাহাজ নিয়ে চলো সে দিকে গাধা।
ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্ত মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে দস্যুদের মধ্যে। সবাই প্রস্তুত। দুটি জাহাজ নিয়ে সেইন্ট ভিনসেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায় দস্যুদল। দেখতে দেখতে দুরন্ত জাহাজ দুটি পৌঁছে যায় সেখানে। হাওয়ার্ডের খবর ছিল অভ্রান্ত। অতর্কিতে তারা জাহাজটিতে আক্রমণ করে। যুদ্ধে কুলিয়ে উঠতে পারে না বণিক জাহাজের ক্যাপ্টেন। ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে সে। জাহাজটা ছিল দাসে বোঝাই। তাদের মাঝখান থেকে শক্তিশালী কয়েকজনকে নিজের দলে ভিড়িয়ে নেয় টেচ। আর বাকি সবাইকে নির্জন দ্বীপে ফেলে রেখে চলে জাহাজটি নিয়ে। জাহাজটির নাম ছিল লা কনকর্ড। পরে টেচ এর সংস্কার করে নাম দেয় কুইন এন’স রিভেঞ্জ। জাহাজে সে চল্লিশটি বন্দুক বসায়।
এর পর আর দুর্ধর্ষ টেচ থেমে থাকে নি। একের পর এক আক্রমণ করে চলে বণিক জাহাজ। এর মধ্যে সে গ্রেট এলেন নামের আরেকটি জাহাজে আক্রমণ করে। মালামাল সব লুটে নিয়ে আগুন ধরিয়ে ডুবিয়ে দেয় জাহাজটি।
ছয়.
লেফটেন্যান্ট মেইনার্ডের জাহাজ।
মুখ খুলে লেফটেন্যান্ট রবার্ট মেইনার্ড- ব্ল্যাক বিয়ার্ডকে গ্রেপ্তার করার জন্য আমাকে ডেকেছেন ভার্জিনিয়ার গভর্নর আলেকজান্ডার স্পটসউড।
রবার্ট মেইনার্ড যেমন দুঃসাহসী তেমনি অভিজ্ঞ। রোজার আর ফ্রায়ার মিল তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাদের চোখ সমুদ্রের দিকে। শান্ত গতিতে ছুটে চলেছে তাদের জাহাজ। দুইদিন ধরে চলছে তাদের জাহাজ। আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখানে চলে গিয়েছিল ওরা একটা জলদস্যু দলকে ধাওয়া করে। তাদের বারোটা বাজানোর পরই একটা সরকারি খবর এসেছে মেইনার্ডের কাছে। কিন্তু এ দুইদিনে একবারও মুখ খোলে নি সে। এটাই তার স্বভাব। আজও হয়তো তেমন কিছুই বলবে না। তবে নাবিকরা বুঝতে পারল কেন তারা ভার্জিনিয়াতে যাচ্ছে।
রোজার- ব্ল্যাক বিয়ার্ড মানে এ সময়ের দুনিয়া কাঁপানো জলদস্যু!
রগচটা হিসেবে বেশ কুখ্যাতি আছে রোজারের। সবাই তাকে বেশ সমঝে চলে। এমন কি প্রিয় বন্ধু ফ্রায়ার মিল পর্যন্ত মাঝে মাঝে তাকে সমীহই করে। ও যখন কথা বলে তখন জাহাজে যেন ভূমিকম্প হয়।
ফ্রায়ার মিল- হ্যা, ওর আসল নাম এডওয়ার্ড টেচ।
ফ্রায়ার মিল ইতিহাসে পণ্ডিত। যে কোনো ঘটনার সাল তারিখ সব তার মুখস্থ। তার এই জ্ঞানের জন্যই অন্য নাবিকরা তাকে ডাকে ফ্রায়ার।
মেইনার্ড- অনেকে কিন্তু বলে ওর নাম এডওয়ার্ড ডারমন্ড।
ফ্রায়ার মিল- হুম কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। ব্রিটেনের ব্রিস্টলে, সম্ভবত ১৬৮০ সালের দিকে একটা ধনী পরিবারে ওর জন্ম। ১৬৯৯ সালের দিকে একটা বাণিজ্য জাহাজে আরও সঠিক ভাবে বললে সম্ভবত এক দাস জাহাজে করে ও ক্যারিবিয়াতে এসেছিল। ক্যারিবিয়াতে যে দ্বীপে ও নামে, তার নাম জ্যামাইকা।
রোজার বাধা দিয়ে বলে- মিল তোমার এই সাল তারিখের ক্যাচক্যাচানি বন্ধ করবে! এমনিতেই মেজাজ খিচড়ে আছে। তোমার এই সাল তারিখ শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে।
ফ্রায়ার মিল- আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আর সাল তারিখ বলব না। আঠারোশ শতাব্দীতে..
রোজার- মিল! আমরা জানি এটা আঠারোশ শতাব্দী।
সবাই হেসে উঠে।
মিল- দুঃখিত। লেখক জনসন লিখেছেন টেচ মানে ব্ল্যাক বিয়ার্ড রাণী এনের যুদ্ধের সময় জ্যামাইকাতে একটা প্রাইভেটিয়ারে নাবিক হিসেবে কাজ করতো। রাণী এন সেই টেচের প্রাইভেটিয়ারকে ফরাসী আর স্প্যানিশ জাহাজ আক্রমণ করার আর লুণ্ঠিত মালামাল নিজের কাছে রাখার অনুমতি দিয়েছিলেন। এটা স্প্যানিশ বিপ্লবের সময়কার ঘটনা।
মেইনার্ড- পরে যুদ্ধ শেষ হলে টেচ হয়ে ওঠে এক অভিজ্ঞ জলদস্যু। প্রাইভেটিয়ারে থাকাকালীনই সে ডাকাতিতে অনেক দক্ষ হয়ে উঠেছিল। সে আর ভাল মানুষ হয় নি, ভিড়ে যায় ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ডের দলে।
রোজার- ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড! মানে নিউ প্রভিডেন্সের সেই কুখ্যাত ডাকাত! কিছুদিন আগে যে সাধারণ ক্ষমা গ্রহণ করল?
মিল- হ্যা ১৭১৮ সালের জুন মাসে হাভানার গভর্নর উডস রজার্সের কাছে।
রোজার- মিল আমি কিন্তু এবারে সত্যি ক্ষেপে যাবো।
মিল- আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত রোজার। কিন্তু সাল তারিখ ছাড়া আমি কথাই বলতে পারি না তাতো তুমি জানোই। যা হোক, সম্ভবত আটরেচট চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই টেচ জ্যামাইকা ছেড়ে নিউ প্রভিডেন্সে চলে আসে। আসলে এটা যে সব প্রাইভেটিয়াররা পরে জলদস্যু হয়ে গিয়েছিল তাদের সবার জন্যই নিরাপদ আস্তানা হয়ে উঠেছিল। সম্ভবত ১৭১৬ সালে টেচ হর্নিগোল্ড এর দলে যোগ দেয়।
রোজার- বাচাল তোতাপাখি মিল, আমি তোমাকে কিন্তু জ্যান্ত খেয়ে ফেলব।
মিল থতমত খায়।
মেইনার্ড- আচ্ছা থামো তোমরা। একটু ওয়াইন গেলা যাক।
মিল- হ্যা এটা কিন্তু ভাল প্রস্তাব। আঠারোশ...
মেইনার্ড- মিল!
মিল বুঝতে পারে এর পরে আরও কথা বললে খবর আছে।(1 to 3)
No comments:
Post a Comment