লিখেছেন খেকশিয়াল (তারিখ: মঙ্গল, ২৮ অক্টো ২০০৮, ০১:০৪ AM)
ক্যাটেগরি: স্মৃতিচারণ ভুতুড়ে
দুদিন ধরে বেশ টিপটিপানি বৃষ্টি হল । কেমন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব চারদিকে । মনে পড়ছে মার বলা সব আষাঢ়ে গল্পগুলো । ছোট থাকতে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলেই মাকে ঘিরে বসত আমাদের ভাই বোনদের গল্পের আসর । মোমবাতি জ্বালিয়ে আধোঁ আলো ছায়ায় আমরা সব ভুতু ভুতু বড় বড় চোখ করে ঘিরে রাখতাম মাকে, আর মা বলে যেত অদ্ভুত সব ভুতের গল্প । তালপুকুরের ভুত, আখের ক্ষেতের ভুত, পুশকল .. পুশকল কি জানো ? সে এক মহা ধুরন্ধর ভুত ! আমাদের গ্রামের দিকে মেছো ভুতগুলিকেই পুশকল বলত । হাট বাজারের দিনে কেউ একটু রাত করে বাড়ী ফিরতে গেলেই নাকি পিছু নেয় বাবাজীরা ! ছোকছোকে জিভ নিয়ে পিছু নেবে তারা । তোমার মাছও নেবে আবার পুতেও রেখে দেবে কোমর অব্দি কাঁদাজলে ! মার এক মামা নাকি পড়েছিল এক পুশকল বাবাজির খপ্পরে । গল্পটা তাহলে বলি, মা যেভাবে বলেছিল সেভাবে,
“ আমার সেজোমামা, একদিন গেছিলো আরেকটু হইলেই ! বাজার কইরা আসতে দেরী । যারা গেছিলো সব আইসা পড়ছে, সে তো আসে না । আমরা ছোটরা তো ঘুমায়া পড়সি । পরে শুনি এই কাহিনী ! হইছে কি, বাবুর আবার তাসের নেশা আছিলো । সে গিয়াই বসছে তাস খেলতে । হাট যখন উঠে উঠে তখন নাকি দুইটা ইলিশ কিন্না ফিরতাছে, অর্ধেক পথ আইছে আর তার মনে হয় পিছে যেন কে আসে, কেমন খসমস শব্দ খালি । সে থামে, শব্দও থামে । সে নাকি বুঝছিল যে কাম তো সুবিধার না ! এইডা তো পুশকল ! তার নাকি অনেক সাহস আছিল, হাঁটতে হাঁটতেই নাকি সে জিগায় তখন,
- কে তুই ? কি চাস ? .. কোন শব্দ নাই , আবার জিগায় মামা,
- কি চাস ? কে তুই, কথা ক ! .. তখন নাকি পিছন থিকা ঘর্ঘর কইরা উঠে ঐটা,
- মাছ দে .. মাছ খামু ..
মামায় তো কয় হইছেনি কাম ! এইবার নাকি সে সাহস কইরা কয়
- এইখানে না, আমার লগে আয় । পুশকলও নাকি আসে, তখন মামা বাড়ি আইসা পড়সে, ভিটায়ও উইঠা গেসে । তাড়াতাড়ি দৌড়াইয়া রান্নাঘরে গেছে মাছ লইয়া, দেখে বড় মামী রান্তাছে কি জানি, মামায় কয়,
- বৌদিরে কামতো একটা হইছে !
মামী কয়, কি হইছে ?
- আরে একটা পুশকল না ছাতা পিছন পিছন আইছে !
- কও কি ? কই ঐটা ।
- আরে চিল্লাইও না, ছেনিটা গরম কইরা দাও শিগ্গির !
- ছেনি দিয়া কি হইব ?
- দাওনা তুমি আমি দেখতাছি, এইটারে এক্টার ব্যবস্থা না করলে জালাইব অনেক !
বড় মামী ছেনি গরম কইরা দিল, মামায় তো ছেনি লইয়া বেড়ার ফাঁক দিয়া ঐটারে জিগায়,
- কিরে আসস ? মাছ খাবি না ? তখন নাকি মামীও শুনে ঐটারে কইতে কেমন একটা ঘরঘর কইরা কয়,
- খামু ! মাছ দে ! মাছ দে !
তখন মামায় নাকি কয়,
- বেড়ার ফাঁক দিয়া জিব্বা দে, যেই বলা অম্নি নাকি এক হাত লম্বা একটা জিব্বা আইসা সাপের মত ঢুকে বেড়ার ফাঁক দিয়া লকলক করতে করতে ! মামীতো দাঁত লাইগা ফিট ! আর মামায় তখনি নাকি ছেনি দিয়া এক্কেরে ছ্যাকা দিয়া দেয় জিব্বায় ! ঐটা তো বলে হুম হাম কইরা কি বিকট চিৎকার বলে ! চেচামেচিতে সব নীচে আইসা পড়ছি আমরা, কি হইসে কি হইসে ! সবাই দেখি মামী শুইয়া আছে একপাশে কাইত হইয়া, মামায় তার মুখে জল দিতাছে । সবাই জিগায় কি হইছে কি হইছে ! মামা আগেই আমাগো সব ছোট যারা তাদের বলল উপরে নিয়া যাইতে, সবাইরে বলল কিচ্ছু না, কিচ্ছু হয় নাই ! কিন্তু কেউ বাইরে যাইবা না, খবরদার ! সকালের আগে কেউ দরজা খুলবা না ! বড়রা তখনি নাকি বুঝছিল, কিছু না কইয়া আমাগো নিয়া সব চইলা গেল । আমরা তো সব ডরায়া শেষ । সকাল হইতেই সব রান্নাঘরের বারান্দায় ভীড় ! কি হইছিল ! কি হইছিল ! আইসা সব দেখি কি, একটা কাক মইরা পইড়া আছে, ঠিক ঐখানেই ।”
আমি পরে জিজ্ঞাসা করতাম মাকে, মা কাক হইল কেন ? মা খালি বলত এইসব ভুতটুত নাকি মরার সময় কাক হইয়াই মরত । আমি তো এমনিতেই বাঁচি না ভুতের ডরে, তার উপর আবার কাকরূপী পুশকল ! খালি ঘ্যানঘ্যান করতাম মা ! মা ! এইগুলা কি আসলেই আছে ? মা হেসে ফেলত আমার ভয় বুঝে, বলত আরে ধুর ! এইগুলা সব গল্প, কি না কি দেখছে ! .. কিন্তু তারপরও ভয় লাগত মনে মনে, ভয়টা আরো বেশী লাগত যখন আমার জ্ঞানী বড় ভাই রিসার্চ করত পুশকল নিয়ে, আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে দিদিকে বলত, “বুঝলি আমার তো মনে হয় এইগুলা সব অতৃপ্ত জেলে, অভাবে অনটনে মারা গেছে, বা মাছ ধরতে গিয়া । কিন্তু মাছের মায়া ছাড়ে নাই মরার পরেও । ”
ক্যাটেগরি: স্মৃতিচারণ ভুতুড়ে
দুদিন ধরে বেশ টিপটিপানি বৃষ্টি হল । কেমন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব চারদিকে । মনে পড়ছে মার বলা সব আষাঢ়ে গল্পগুলো । ছোট থাকতে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলেই মাকে ঘিরে বসত আমাদের ভাই বোনদের গল্পের আসর । মোমবাতি জ্বালিয়ে আধোঁ আলো ছায়ায় আমরা সব ভুতু ভুতু বড় বড় চোখ করে ঘিরে রাখতাম মাকে, আর মা বলে যেত অদ্ভুত সব ভুতের গল্প । তালপুকুরের ভুত, আখের ক্ষেতের ভুত, পুশকল .. পুশকল কি জানো ? সে এক মহা ধুরন্ধর ভুত ! আমাদের গ্রামের দিকে মেছো ভুতগুলিকেই পুশকল বলত । হাট বাজারের দিনে কেউ একটু রাত করে বাড়ী ফিরতে গেলেই নাকি পিছু নেয় বাবাজীরা ! ছোকছোকে জিভ নিয়ে পিছু নেবে তারা । তোমার মাছও নেবে আবার পুতেও রেখে দেবে কোমর অব্দি কাঁদাজলে ! মার এক মামা নাকি পড়েছিল এক পুশকল বাবাজির খপ্পরে । গল্পটা তাহলে বলি, মা যেভাবে বলেছিল সেভাবে,
“ আমার সেজোমামা, একদিন গেছিলো আরেকটু হইলেই ! বাজার কইরা আসতে দেরী । যারা গেছিলো সব আইসা পড়ছে, সে তো আসে না । আমরা ছোটরা তো ঘুমায়া পড়সি । পরে শুনি এই কাহিনী ! হইছে কি, বাবুর আবার তাসের নেশা আছিলো । সে গিয়াই বসছে তাস খেলতে । হাট যখন উঠে উঠে তখন নাকি দুইটা ইলিশ কিন্না ফিরতাছে, অর্ধেক পথ আইছে আর তার মনে হয় পিছে যেন কে আসে, কেমন খসমস শব্দ খালি । সে থামে, শব্দও থামে । সে নাকি বুঝছিল যে কাম তো সুবিধার না ! এইডা তো পুশকল ! তার নাকি অনেক সাহস আছিল, হাঁটতে হাঁটতেই নাকি সে জিগায় তখন,
- কে তুই ? কি চাস ? .. কোন শব্দ নাই , আবার জিগায় মামা,
- কি চাস ? কে তুই, কথা ক ! .. তখন নাকি পিছন থিকা ঘর্ঘর কইরা উঠে ঐটা,
- মাছ দে .. মাছ খামু ..
মামায় তো কয় হইছেনি কাম ! এইবার নাকি সে সাহস কইরা কয়
- এইখানে না, আমার লগে আয় । পুশকলও নাকি আসে, তখন মামা বাড়ি আইসা পড়সে, ভিটায়ও উইঠা গেসে । তাড়াতাড়ি দৌড়াইয়া রান্নাঘরে গেছে মাছ লইয়া, দেখে বড় মামী রান্তাছে কি জানি, মামায় কয়,
- বৌদিরে কামতো একটা হইছে !
মামী কয়, কি হইছে ?
- আরে একটা পুশকল না ছাতা পিছন পিছন আইছে !
- কও কি ? কই ঐটা ।
- আরে চিল্লাইও না, ছেনিটা গরম কইরা দাও শিগ্গির !
- ছেনি দিয়া কি হইব ?
- দাওনা তুমি আমি দেখতাছি, এইটারে এক্টার ব্যবস্থা না করলে জালাইব অনেক !
বড় মামী ছেনি গরম কইরা দিল, মামায় তো ছেনি লইয়া বেড়ার ফাঁক দিয়া ঐটারে জিগায়,
- কিরে আসস ? মাছ খাবি না ? তখন নাকি মামীও শুনে ঐটারে কইতে কেমন একটা ঘরঘর কইরা কয়,
- খামু ! মাছ দে ! মাছ দে !
তখন মামায় নাকি কয়,
- বেড়ার ফাঁক দিয়া জিব্বা দে, যেই বলা অম্নি নাকি এক হাত লম্বা একটা জিব্বা আইসা সাপের মত ঢুকে বেড়ার ফাঁক দিয়া লকলক করতে করতে ! মামীতো দাঁত লাইগা ফিট ! আর মামায় তখনি নাকি ছেনি দিয়া এক্কেরে ছ্যাকা দিয়া দেয় জিব্বায় ! ঐটা তো বলে হুম হাম কইরা কি বিকট চিৎকার বলে ! চেচামেচিতে সব নীচে আইসা পড়ছি আমরা, কি হইসে কি হইসে ! সবাই দেখি মামী শুইয়া আছে একপাশে কাইত হইয়া, মামায় তার মুখে জল দিতাছে । সবাই জিগায় কি হইছে কি হইছে ! মামা আগেই আমাগো সব ছোট যারা তাদের বলল উপরে নিয়া যাইতে, সবাইরে বলল কিচ্ছু না, কিচ্ছু হয় নাই ! কিন্তু কেউ বাইরে যাইবা না, খবরদার ! সকালের আগে কেউ দরজা খুলবা না ! বড়রা তখনি নাকি বুঝছিল, কিছু না কইয়া আমাগো নিয়া সব চইলা গেল । আমরা তো সব ডরায়া শেষ । সকাল হইতেই সব রান্নাঘরের বারান্দায় ভীড় ! কি হইছিল ! কি হইছিল ! আইসা সব দেখি কি, একটা কাক মইরা পইড়া আছে, ঠিক ঐখানেই ।”
আমি পরে জিজ্ঞাসা করতাম মাকে, মা কাক হইল কেন ? মা খালি বলত এইসব ভুতটুত নাকি মরার সময় কাক হইয়াই মরত । আমি তো এমনিতেই বাঁচি না ভুতের ডরে, তার উপর আবার কাকরূপী পুশকল ! খালি ঘ্যানঘ্যান করতাম মা ! মা ! এইগুলা কি আসলেই আছে ? মা হেসে ফেলত আমার ভয় বুঝে, বলত আরে ধুর ! এইগুলা সব গল্প, কি না কি দেখছে ! .. কিন্তু তারপরও ভয় লাগত মনে মনে, ভয়টা আরো বেশী লাগত যখন আমার জ্ঞানী বড় ভাই রিসার্চ করত পুশকল নিয়ে, আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে দিদিকে বলত, “বুঝলি আমার তো মনে হয় এইগুলা সব অতৃপ্ত জেলে, অভাবে অনটনে মারা গেছে, বা মাছ ধরতে গিয়া । কিন্তু মাছের মায়া ছাড়ে নাই মরার পরেও । ”
No comments:
Post a Comment