Responsive Ads Here

19 January 2012

চিঠি

'তুমি পাগল বল আর যাই বল তবুও তোমার আমি, তুমি নিঃস্ব হবে কভু থেমে গেলে আমার এমন পাগলামি'

"লীন"।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছে। নিষাদদের নতুন বন্ধু। বাইরে থেকে দেখে অনেক রাফ অ্যান্ড টাফ মনে হলেও মিশলেই বোঝা যায় ওর মতো মেয়ে খুব কমই আছে।
তাই অল্পকিছুদিনের মধ্যেই অনেক আপন করে নেয় ওদের। খুব বেশি বকবক করে। নিশাদ খুব অবাক হয় টিংটিঙে মেয়ে এতো কথা বলে কিভাবে?

আর ত্রিশা ওর নাম দিয়েছে "জেনারেটর"।
দেখা যাচ্ছে ত্রিশা,নুহা,রাসেল,লীন আড্ডা দিচ্ছে। হয়তো এমন সময় ত্রিশার বয়ফ্রেন্ডের ফোন এল। তখন ত্রিশা সাইডে গিয়ে কথা বলছে। হটাত ঝাড়ি দিয়ে বলে "উফফ লীন তোর জেনারেটরটা একটু থামাবি?" কিন্তু কে শোনে কার কথা।
লীনের ঘুমকাতরতার কথা সবাই জানে। নুহা আর রাসেল তো ওর নাম প্রায় গিনেস বুকে উঠানোর জন্যে এক পায়ে খাডা। ক্লাসে প্রায়ই লেট করে আসে লীন। আর ক্লাস মিস দেওয়া তো আছেই। নিশাদ ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তাই প্রক্সি দেওয়ার গুরুদায়িত্বটা তার উপরই।

সারাক্ষণ এ-ওর সাথে খোচাখুচি লেগেই থাকে লীনের। আর একেকজনের বাহারি সব নাম লীনেরই দেওয়া।
সামনেই লীনের বার্থ ডে। এ নিয়ে তাদের মাতামাতির শেষ নেই।
নুহা - এবার আর কিপ্টেমি করে বাচতে পারবি না। ভালো কোথাও ট্রিট না পেলে হাড সব ভেঙ্গে কাবাব বানিয়ে খাব।
লীন - হু। মুড়ি ভর্তা খাওয়াব এবার। হাহাহা।

রাত তখন ঠিক ১২টা। নিশাদ বার্থ ডে উইশ করে এস.এম.এস পাঠায় লীনকে।তারপর ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে । এসএমএস আর delivered হয় না। pending দেখে ঘুমিয়ে পডে সে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে এখনও ওটা pending।
নিশাদের কেমন জানি লাগলো ব্যাপারটা। ফোন এর উপর ফোন দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু লীনের ফোন সুইচড অফ।
তারপর নিশাদ ত্রিশাকে ফোন দিল।

নিশাদ- ওই, তুই লীনের কোন খবর জানিস ?
ত্রিশা - নাতো।
নিশাদ - নাতো মানে? খাওয়া আর মেকাপ ছাডা আর কিছু পারিস তুই? লীন তোর সবচেয়ে ভালো বন্ধু।
ওর খবরটা পর্যন্ত তোর কাছে নাই। অদ্ভুত মেয়ে তুই ।
ত্রিশা - অহ তুমি তো সারাদিন বাতাস খাও না?
(মুখের উপর ফোন রেখে দেয় নিশাদ)

ত্রিশা এরপর ফোনে লীনকে অনেক ট্রাই করল, আন-রিচেবল। তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হল না ব্যাপারটা। কারন লীনের জন্যে এসব ব্যাপারি না । ওতো এরকমই। বদমাশটা পার্টি না দেওয়ার জন্ন্যে হয়তো কোন ট্রিক্স করছে।

এরপর অনেকদিন লীনের কোন খবর নেই। সেমিস্টার ফাইনাল নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পডে সবাই।তাই খুব একটা ভাবার সম্য পায়নি কেউই।

তিন মাস পর নিশাদ,ত্রিশা,নুহার এর বার্থডের দিন এল (ওরা অভিন্ন সত্তা এক এক জায়গা থেকে এসে পরিচিত হলেও কাকতালীয়ভাবে সবার বার্থডে একইদিনে মিলে যায়!) সকাল এগারটায় ঘুম ভাঙ্গে নিশাদের । ঘুম থেকে উঠে সেভেন মিসডকল দেখে ব্যাক দ্যায় সে। অপরিচিত এক মহিলা। পরিচয় দিলেন উনি লীনের মা। (লীন কখনোই ওদের পরিবার নিয়ে তাদের কিছু জানায়নি) সালাম দিয়েই নিশাদ লীনের কথা জিজ্ঞেস করে আন্টিকে। আন্টি ওদেরেক বাসায় যেতে বলে রাতে। ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দিল সে। হটাত ডোরবেলের আওয়াজ শুনে শার্ট গায়ে ঝুলিয়ে দরজার দিকে যায় সে। কুরিয়ার এসেছে তার নামে। খুলে দেখে একটি গীটার । অবাক হয় সে। সাথে একটি পোস্টকার্ড। ভেতরে একটি চিঠি।

খুলে দেখল লীন পাঠিয়েছে।কিছুই মাথায় ঢোকে না তার। তবে কি বদমাশটা সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে এসব করছে? ক্লাসের সময় প্রায় হয়ে এসেছে।তাই চিঠি মানিব্যাগে রেখে তৈরি হয়ে নিল সে।
বাইক সাইড করে নিশাদ ক্লাসে যাওয়ার আগে ভাবল ক্যান্টিনে একবার ঢু মেরে আসা যাক। ক্যান্টিনে গিয়ে দেখল ত্রিশা,নুহা,রাসেল ক্যান্টিনে বসে আছে ।
নিশাদ - কি ব্যাপার তোরা ক্লাসে যাসনি কেন? আমার প্রক্সি কে দিবে?
সবার গম্ভীর মুখ দেখে চুপ মেরে গেল নিশাদ ...
নিশাদ দেখল ওদের সামনে টেবিলে তিনটা গিফট প্যাকেট। বুঝতে বাকি রইল না ওর সাথে যা ঘটেছে সকালে,বাকি দের সাথেও একই রকম হয়েছে।

ত্রিশাদের বাসা নিষাদদের একটু সামনেই। সন্ধ্যায় বাইক নিয়ে ওর বাসার সামনে দাডিয়ে মিসকল দেয় সে। ত্রিশা নেমে আসে। তারপর লীনের বাসার জন্যে রওনা হয় দুজন,পথে নুহাকে ফোন দেয় ত্রিশা। নুহা জানাল তারা পৌঁছে গেছে প্রায়।
বাসায় ঢুকল সবাই। আন্টি এল। তারপর ওদের লীনের রুমে নিয়ে গেল। বড্ড অগোছালো মেয়েটার
বেডরুম এতো গোছালো দেখেই নিশাদ বুঝতে পারে অনেকদিন তার পা পডেনি এখানে। অজানা এক শঙ্কায় তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠে...

নিশাদ বলল , আন্টি লীন.....
এরপর সবচেয়ে বড সারপ্রাইজটা তখন অপেক্ষা করছিল তাদের জন্যে।
আন্টি যা বলল শুনে ওরা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেই রোগটি ধরা পডে তার। "Seziure dissorder" । ও জানতো আসতে আসতে ওর ব্রেন সেলগুলো অকেজো হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকের পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসছিল তার। তাই কাউকে তার সাথে জডাতে চায়নি সে। তাই সে চাইনি সারাক্ষণ উচ্ছল তরুণীর নিথর দেহ দেখে তার ফ্রেন্ড্ররা কষ্ট পাক।তাই মা কে সে না করে দিয়েছিল কাউকে কিছু জানাতে। আর মৃত্যুর কিছুদিন আগেই সবার জন্যে একটি করে গিফট কিনে মা কে দ্যায় সে। বলেছিল ওদের বার্থ ডের ডেট এ পোস্ট করে দিতে। নিশাদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আন্টির দিকে... ত্রিশা নুহার হাত ধরে আছে...

নিশাদ,ত্রিশা,রাসেল,নুহা দের মেনে নিতে কষ্ট হয় ওদের সবসময় হাসিখুশি থাকা বন্ধুটি যার সাথে কিনা জডিয়ে আছে তাদের সকল মজার স্মৃতি ,সেই এখন চুপটি মেরে তাদের কাছে স্মৃতি হয়ে গেছে। কিছুই ভাবতে পারছে না তারা। হয়তো এখনি অন্য রুম থেকে লীন ছুটে এসে বলবে "দোস্ত দেখলি কি সারপ্রাইজটাই না দিলাম"
বড্ড নাটক করার স্বভাব; মেয়েটার রাগ লাগলো নুহার । নিশাদের অসহ্য লাগছিল। কিন্তু না। কিন্তু আন্টির চোখই বলে দিচ্ছিল কঠিন বাস্তব কথা গুলো আর যাই হউক নাটক হতে পারে না।

নিশাদ,ত্রিশা,নুহা কারো সাথে কোন কথা বলে না। লীনের সাথে নিশাদ আর ত্রিশা প্রায় ছায়ার মতই থাকতো। তাদের মাথার ভেতর যেন কেউ টাইম মেশিন লাগিয়ে দিয়েছে। ওই মেশিন কখনো তাদের নিয়ে যাচ্ছে নুহার বার্থডে পার্টিতে,কখনো ক্যান্টিনে, রিকসাই লেগে স্মৃতির জামা ছিডে যাওয়ার সময়ে। কিন্তু সব জায়গায় কেন যেন বাকি সবার মুখগুলো ঝাপসা মনে হচ্ছে। মৃদু আলোয় শুধু লীনের চেহারাটা দেখা যাচ্ছে।

নিশাদ শুয়ে পডল। কিন্তু ঘুম আসছে না। কেউ আর তাকে সকালে তার বাসায় এসে বলবে না , "ওই হতচ্ছাডা আর কতো ঘুমাবি। একটু পর এক্সাম। এখন না উঠলে বাকি সময় পিয়নের টেবিলে ঘুমিয়েই কাঁটাতে হবে" ।
সকালে হয়তো মোবাইল হাতে নিয়ে কারো সাথে খুনসুটি করা হবে না এসএমএসে। তার ভ্যানভ্যান গলায় গান শুনে আর কেউ বলবে না " আরেহ দোস্ত!অন্নেক ভালো হইসে...কাশি দিয়ে আরেকটা কর না দোস্ত ;)" ত্রিশা আর রাসেলের ঝগড়াও এখন আর কেউ থামাবে না। ওদের যতই ঝামেলা হোক লীন ওগুলোকে ঝামেলাই মনে হতে দিতো না।

নাহ আর ভাবতে পারছে না নিশাদ । চারপাশে তাকিয়ে দেখল সে। কিছুই বদলায়নি। চারপাশের পৃথিবী ঠিক দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গাতেই। ক্যান্টিনে এখনও আড্ডা বসে। থাকে না শুধু নিশাদ,লীন,ত্রিশারা। এখনও সকালে এসএমএস আসে নিশাদের মোবাইলে। কিন্তু রিপ্লায় দেওয়া হয় না। হাঁ,শুধু বদলে গেছে নিশাদের জগতটাই । চারপাশে সবই অন্ধকার দেখতে পায় সে। রাতে দম আটকে আসে তার। যার সাথে এক সেকেন্ড কথা না বলে থাকতে পারে না তাকে ছাডাই কাটাতে হবে আরও অনেক গুলো বছর ।

লীনের দেওয়া চিঠি পকেট থেকে বের করে সে...

নিশাদ , ধুর বোকা এতো ভাবার কি আছে ? তোকে ঘুম থেকে তুলতেই তো হাপিয়ে উঠতাম,আর এখন না ঘুমিয়ে আজেবাজে এসব ভাবছিস না? উফ আমাকে না জালালে তোর হয় না? তুই রাসেলের পকেট থেকে আজও সিগারেটের প্যাকেট চুরি করেছিস। আমাকে আর কেউ তোর এসবের বিচার দিতে আসবে না। ত্রিশার সাথে তর্ক দেখে আর বলতে পারবি না আমি খালি শপিং আর ঝগডা করি। তুই আমার উপর হঠাত হঠাত রেগে যেতে পারবি না আর কখনোও। বিকেল হলেই ত্রিশাদের না বলে চুপি চুপি খেতে যাওয়ার ঝামেলাও নেই। সামনের মাসের ছুটিতে কক্সবাজারে তোরা হয়তো অনেক মজা করবি, অনেক ছবি তুলবি, ফেসবুকে দিবি মজার মজার সব স্ট্যাটাস। কিন্তু আমি আর তোদের কোন কিছুরই অংশ হতে পারব নারে। প্লিজ তোদের ছবি গুলোয় আমাকে ট্যাগ দিস! আরেহ তুই কাদছিস ক্যান? উফফ এই পাগলটারে কে যে বুঝাবে সত্যি কথাটা ! শুন ,ভাবিস না আমি আর নেই, স্বাধীনতা পেয়ে গেছিস। এখনও বৃষ্টিতে ভিজলে আমি বলবো "প্লিজ নিশাদ বাসায় যা। এভাবে ভিজিস না। খুক খুক করে কাশলে বউ পাবি না। শ্বশুর ভাববে যক্ষ্মা হইসে।"
নিষাদ জানিস আমি বড্ড সুখে আছি।আমার জন্যে একদম চিন্তা করবি না। আর জানিস আমার জগতটা না অনেক বদলে গেছে । আমার এখন আড্ডা দেবার আকূলতা নেই। কারো কাছে আর ফুচকা খাওয়ানোর আবদার করতে পারি না। কারো প্রতিই যেন আমার আর কোন অধিকার নেই। কিন্তু এই মুক্তি নিতে যে আমি হারিয়ে ফেললাম আমার চারপাশের জগতটাকে। আমি সবসময়ই তোদের সাথে কথা বলি। কিন্তু আমার কথা গুলো তোদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উপায় আমার জানা নেই রে ...আমি বড্ড স্বার্থপর হয়ে গেছি ...

চিঠিটা ভিজে গেছে। নিশাদ দেখল সে কাঁদছে। আরেহ কাঁদছে কেন সে ? কেউ দেখে ফেললে কি হবে। সে তো এমন ছিল না! নাহ কান্না থামাতে পারে না সে...

বাস্তবতা আর স্বপ্নের এক মায়াজাল ছিন্ন করে এভাবেই কাছের মানুষগুলো আমাদের থেকে অনেক দূরে চলে যায়। তারা যাওয়ার পরও হয়তো আমরা আনমনে তাদের সাথে কথা বলি।কিন্তু তাদের কান পর্যন্ত তা পৌছায় না ...নিজের অজান্তেই তাদের স্মৃতিগুলো আমরা আমৃত্যু আগলে রাখি। বাস্তবতা আসলেই অনেক নির্মম ...

গল্পটি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড লীনকে উৎসর্গ করে লেখা। ওর গুঁতানো ছাডা আমার এই গল্প কখনো শেষ হতো না।

লিখেছেন- Ruinous Rafi

No comments:

Post a Comment