Responsive Ads Here

20 January 2012

দুটি আত্মা ও একটি থার্টি ফার্স্ট নাইট

মিজান ও তাহিয়ার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে দুবছর হল ।


এরপর থেকে মিজান আজকাল অনেক আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পরেছে । কথা কম বলে , পড়াশুনায় মন দিয়েছে । মিজান ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বি বি এ পড়ছে । তাহিয়া ঢাকায় একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ২য় বর্ষের ছাত্রী । দুজনের দেখা অনেক বেশি নাটকীয় , অনেকটা গল্পের মত । মিজান এর বোন তাহিয়ার পরিচিত , সেখান থেকে কাহিনীর সূত্রপাত । পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলের এক অনুষ্ঠানে দেখা দুজনের । সেখান থেকে কথা হল , কথা থেকে ভালোলাগা হল , কালের আবর্তে পরে সে ভালোলাগা ভালবাসায় পরিণত হল । অথবা হয়তো সেটা ভালবাসা ছিলনা , কেবলই ভালোলাগা ছিল । লোকে বলে ভালোলাগা আর ভালবাসা এক নয় ।


৩১ তারিখ সকাল টা মিজানের ভালোমতোই শুরু হল । সকাল এ ক্লাস , বিকেল এ বন্ধুদের সাথে আড্ডা , সবাই মিলে প্ল্যান করল রাতে মাঠে বার-বি-কিউ করবে , আরও কত কি ! বার বি কিউ এর আইডিয়া ছিল রাশেদের ।


" দোস্তরা , রাতে কাজ কর্ম ছাড়া কাটাবি কিভাবে ? চল একটা পার্টি করি । " রাশেদ আড্ডায় প্রস্তাব দেয় ।
রাশেদের প্রস্তাব সর্ব সম্মতি ক্রমে গৃহীতও হয় । তখনি সুজন বলে উঠে -
" পার্টির টাকা কি তুই দিবি ? "
" নাহ , ওর আব্বা দিবে , বড়লোক মানুষ । " পাশ থেকে সনেট ফোঁড়ন কাটে ।
" আহ তোরা থামত! " মিজান বিরক্ত হয় । " আমরা সবাই ভাগাভাগি করে টাকা দিবো,তাহলেই তো হল । "
সবাই মোটামুটি মিজানের কথা মেনে নিল । ঠিক হল টাকা জোগাড় হলে রাশেদ আর সুজন যাবে মুরগি আনতে , মিজান ও সনেট কয়লা জোগাড় করবে । মিজান সনেট কে নিয়ে রিকশায় করে নিউ মার্কেট রওনা দেয় ।
" আচ্ছা তুই তাহিয়ার ব্যাপারটা কি করলি বলতো ? " সনেট যেতে যেতে হঠাৎ মিজান কে প্রশ্ন করে ।
" এ ব্যাপারে কোনও কথা না , ব্যাপারটা ভুলে যা । " মিজান উদাস কণ্ঠে বলে উঠে । তার স্মৃতিতে ভেসে উঠে কয়েকবছর আগের সুখ স্মৃতি ।


কয়েক বছর আগের কোন এক সময় । বছরের শেষ সন্ধ্যা -


তাহিয়া আর মিজান ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে বসে আছে । সূর্য অস্ত গেলো কিছুক্ষন আগে । সেটা ছিল বছরের শেষ সূর্যাস্ত । একটা ঠাণ্ডা অথচ মিষ্টি হাওয়া বইছে বিকেল থেকেই । তাহিয়ার হাতে মিজানের হাত , দুজনের চোখে মুখেই নূতন বছর সুন্দর করে শুরু করার প্রত্যয় ।


" এর পরের বছর কি আমরা এতো আনন্দ করতে পারব ? " তাহিয়া বলে উঠল । সন্ধ্যার হিমেল বাতাসে ওকে বেশ লাগছিলো দেখতে । তাহিয়া নীল শাড়ী পরেছিল , কি করে যেন শাড়ির নীল রঙ আর ধানমণ্ডি লেকের পানির নীল রঙ মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে ।
" না পারবোনা । " মিজান চাঁছাছোলা একটি জবাব দিল । তারপর দুজনে চুপচাপ । মিজানই নিরবতা ভাঙল -
" এই প্রশ্ন টা আজকে তুমি কয়বার করেছ ? " তাহিয়া কিন্তু চুপ করে রইল , এটা ওর রাগ প্রকাশ এর ধরণ , রেগে গেলে তাহিয়া কারো সাথে কথা বলেনা ।
" অবশ্যই এর পরের বছর আমরা আনন্দ করবো , এর চাইতেও বেশি ঘুরোঘুরি করবো , যদি তুমি পাশে থাকার কথা দাও । " মিজান তাহিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ।
" এবার বল , আমাকে কতটা ভালবাস ? " মিজান মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে ।
" অনেক ভালবাসি । " বলেই তাহিয়া হেসে দেয় , দুজনে হাত ধরে রাতের ঢাকার পথে হারিয়ে যায় ।


বর্তমান সময় - ৩১ তারিখ সন্ধ্যা বেলা-




তাহিয়ার কাছে সবচাইতে বিরক্তিকর জিনিস হল রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম । কিছু কেনাকাটা করতে নিউ মার্কেট যাচ্ছিল তাহিয়া, আরও ভালো করে বললে কিছু মেডিক্যাল এর বই কিনতে । আধা ঘণ্টা ধরে জ্যামে বসে সিদ্ধ হচ্ছে এখন । তাই মেজাজ টা চরম খারাপ । সাথে বসে থাকা বান্ধবী নিকিতা নন - স্টপ মোবাইলে বক বক করে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে ।
" এই তুই থামবি , তোর প্রেম পিরিতি বাসায় গিয়ে করিস , রাস্তায় না । " তাহিয়া নিকিতা কে ধমক দেয় । নিকিতা তাহিরা কে চোখ রাঙায় , ইশারায় চুপ করতে বলে , সে তার ছেলে বন্ধুর সাথে ফোনে প্রেম -আলাপ করছিল খুব আনন্দের সাথে , মাঝখান থেকে বেরসিক তাহিয়া বাঁধা দিল ।
" তোর মত খটমট মানুষ যে কিভাবে , বেঁচে থাকে , প্রেম মানে কি তা না বুঝলেও অন্তত দুজনের প্রেমে বাঁধা না দিয়ে থাকতে পারবিনা কেন ? " তাহিয়া রেগে যায় ।
" তুই ঠিকি বলেছিস রে , আমি আসলেই একটা বেরসিক , প্রেম বুঝিনা । " তাহিয়ার বিরক্তি হঠাৎ উদাসীনতায় পরিণত হয় , গলায় কেমন যেন এক হাহাকারের সুর । নিকিতা তাহিয়ার স্বরের পরিবর্তন বুঝতে পারল , সাথে সাথে বলে উঠল -
" আমি ওভাবে বলতে চাইনি রে , সরি দোস্ত । "
" বাদ দে , মার্কেট এসে পরেছে প্রায় , জ্যামও ছুটে গিয়েছে । " বলেই তাহিয়া আলোচনা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয় ।




বর্তমান সময় - ৩১ তারিখ রাতের বেলা / থার্টি ফার্স্ট নাইট


ঢাকার রাস্তায় মানুষ যেন উপচে পরেছে । সবাই যেন আজকের রাত টাকে স্মরণীয় করে রাখার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ । নিউ মার্কেট এলাকা তো রীতিমত জন সমুদ্রে পরিণত হয়েছে । সেই জন সমুদ্র দিয়েই মিজান আর সনেট সাঁতরে যাচ্ছে । কয়লা কেনা শেষ , দুজনের গন্তব্য এখন নিউ মার্কেট গেট সংলগ্ন খাবারের দোকান । বহু কষ্টে দুজনে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর নাস্তার অর্ডার দিলো । মানুষের ভিড়ে আর নিঃশ্বাসে পরিবেশ কেমন যেন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ।
" এই যে ভাই , দুপ্লেট ফুচকা দিনতো , ঝাল একটু কম দিবেন । " একটা অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে মিজান চমকে উঠল । পাশে ঘুরে দেখল তাহিয়া দাঁড়িয়ে আছে । মিজান বিস্ময়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল , হয়তো একেই নিয়তি বলে । এতক্ষণে তাহিয়া মিজান কে খেয়াল করল তারপর দুজনে নিশ্চুপ । সময় বয়ে চলছে সময়ের মতো । পুরানো সেই দিনগুলোর মতো মিজানই প্রথম নিরবতা ভাঙল-
" কেমন আছো তাহিয়া ? "
" ভালো , তুমি কেমন আছো ? " তাহিয়া যেন একটু অপ্রস্তুত ।
" ভালো নেই , তবে যদি একটু কথা বলার সুযোগ দাও তাহলে হয়তো ভালো থাকবো । " মিজান একটু হেসে উত্তর দেয় , তবে সে হাসির মাঝে কোন প্রাণ নেই যেন , অনেক মলিন সে হাসি । তাহিয়া নিরবে সম্মতি দেয় । দুজনে হাঁটতে হাঁটতে নিউ মার্কেটের কোলাহল ছেড়ে ঢাকা ভার্সিটির নিরবতায় প্রবেশ করল । তখনও খুব একটা রাত হয়নি , তবে ঝি ঝি পোকা ডাকতে আরম্ভ করে দিয়েছে ।
" আজকে রাতে কি করবে ? " মিজান কথা খুঁজে না পেয়ে প্রশ্ন করে ।
" পড়াশুনা , কালকে পরীক্ষা , তুমি কি করবে ?"
" রাতে বন্ধুরা মিলে বার বি কিউ পার্টি করবো ভাবছিলাম । "
" ভালোই তো , মজায় থাকবে । " তাহিয়া যেন অনেকটা সহজ হয়ে আসে ।
" আমাকে ক্ষমা কর তাহিয়া । " বলেই মিজান দাঁড়িয়ে পরে।
" ক্ষমা প্রার্থনাটা একটু দেরিতে হয়ে গেলো না ? " তাহিয়া যেন একটু অবাক হয় ।
" দুবছর তো কম চেষ্টা করলাম না , তোমাকে ছাড়া বাঁচা আমার পক্ষে অসম্ভব । আর একটাবার সুযোগ দাও , কথা দিচ্ছি , নতুন বছরে নিজেকে নতুন করে গড়ব । " এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মিজান বিরতি নেয় । দুজনের নীরবতায় রাতের নিস্তব্ধতা যেন আরও চেপে বসে। অবশেষে তাহিয়া মুখ খুলে -
" আর তুমি কি করে বুঝলে , তোমাকে ছাড়া আমি বেঁচে থাকবো ? " বলেই তাহিয়া মিজানের হাতে হাত রাখে । তাহিয়ার মুখে হাসি । মিজান তাহিয়ার হাত শক্ত করে ধরে । তারপর দুজনে পুরনো দিনের মত ঢাকার রাস্তায় হারিয়ে যায় । পুরনো দুটি আত্মার আবার নূতন করে মিলন হয়।


লিখেছেন-Jishan Rahman

No comments:

Post a Comment