তীব্র আলোর ঝলকানিতে ক্ষণিকের জন্য অন্ধ হয়ে গেলো মিলি। মিনিটখানেক লাগলো নতুন আলোতে নিজের চোখকে মানিয়ে নিতে। আলো সয়ে আসতেই চোখ মিটমিট করে বুঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে। আশে পাশে কিছুই পরিচিত মনে হল না। সে দাঁড়িয়ে আছে একটা মাটির ঘরের বাইরে। ঘরের ভেতর থেকে একটা ছোট বাচ্ছার একটানা কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সেই সাথে জোড়ে জোড়ে কাউকে ধমক দিচ্ছে এক মহিলা কণ্ঠ। মিলি আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। শেষ যতটুকু মনে আছে তার, সে নিজের পড়ার রুমে ছিল। একটা মেয়ে এসে তার পেছনে দাঁড়ায়। এরপর সে হাত বাড়িয়ে সেই মেয়েটির বাড়ানো হাত ছোঁয়। এরপরেই মিলি নিজেকে এখানে আবিষ্কার করে।
অবচেতন মনে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো মিলি ঐ বাড়ির দরজার দিকে। রুমের দরজাটা খোলা। বিছানার উপর শুয়ে আছে একটি মাস ৫-৬ এর বাচ্চা। পাশে একটা কাঠের পুতুল। পুতুলটা হাত থেকে একটু দূরে পড়ে গেছে দেখে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে সে। বিছানার নিচে মাটিতে একটা প্লাস্টিকের চাদর বিছিয়ে তরকারি কাটছেন একজন মাঝবয়সী মহিলা। তার পাশে মুখ গোমড়া করে বসে আছে একটি মেয়ে। মেয়েটির উপর মহিলার মেজাজ খারাপ কোনও কারণে। থেকে থেকেই বকা ঝকা করছেন। মিলি মেয়েটিকে দেখে অবাক হল। ড্রেস থেকে শুরু করে বাকি সবটুকুই সেই মেয়েটার সাথে মিলে যায় যার হাত ধরার পর সে এখানে চলে এসেছে। যদিও মেয়েটার মুখ এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সুন্দর কোমলমতি চেহারা। গায়ের রঙ দুধে আলতা না হলেও নেহায়েত খারাপ নয়। চোখগুলো সুন্দর, মায়াভরা। এই মেয়েটিকে দেখেই সে এতো ভয় পেয়েছে। ভাবতেই হাসি পেলো মিলির। দরজায় টোকা দিয়ে জিজ্ঞেছ করলো, “ভেতরে আসতে পারি?”
মিলিকে অবাক করে দিয়ে তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না। মহিলা সেই একই ভাবে মেয়েটিকে বকা দিয়ে যাচ্ছে। মিলি ভাবল শুনতে পায় নি। আরেকটু গলা চরিয়ে বলল সে। কিন্তু এবারেও কোনও ভাবান্তর নেই। এর মাঝে মহিলাটি মেয়েটির সাথে খুব দ্রুত কিছু কথা বলল। সে সুত্রে মিলি জানতে পারলো, মেয়েটির নাম মরিয়ম। তার বাবা ইংরেজদের জুটমিলে কাজ করে। তাকে খাবার নিয়ে পাঠানোর জন্য তার মা এতখন ধরে বলছে কিন্তু সে কিছুতেই নরবে না। তাই মহিলা, অর্থাৎ মরিয়মের মা ক্ষেপে গিয়ে মেয়েকে উল্টাপাল্টা কথা শুনাচ্ছেন। খাবার নিয়ে না গেলে আজকে তার বাবা আসার পর মার দেয়া হবে, তার দুপুরের খাবার বন্ধ, বাড়ি থেকে বের হতে দিবে না ইত্যাদি।
মিলির কাছে ব্যাপারটা কেমন যেনও গোলমেলে ঠেকল। ইংরেজদের জুটমিলে কাজ করে মানে কি? এখানে ইংরেজ আসলো কোথা থেকে? আর এই এলাকায় জুটমিল তার জানামতে একটা আছে। কিন্তু তা গত ৩০ বছর ধরে বন্ধ। তাহলে মহিলা কিসের কথা বলেছেন?
অবশেষে মায়ের উপর রেগেমেগে মরিয়ম রাজি হল খাবার নিয়ে যাবার জন্য। তার মা আগেই খাবার ঘুছিয়ে রেখেছিলেন। যেমন জানতেন যে মেয়ে শেষতক রাজি হবে। একগাল হেসে বললেন জলদি ফিরে আসার জন্য। ফেরার পথে যেনও গ্রামের বদ মেয়েগুলোর সাথে খেলাধুলা করে সময় নষ্ট না করে।
মিলি এখনো সেই দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। বলতে গেলে ছোট ঘরটার পুরো দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছে সে। তাই মরিয়মের বাইরে বের হতে হলে অবশ্যই তাকে সরিয়ে বের হতে হবে।
মরিয়ম এমনভাবে মিলির দিকে এগিয়ে এলো যেনও সে মিলিকে দেখতেই পেলো না। রাগে গজগজ করছে মেয়েটি। অতঃপর মিলিকে চমকে দিয়ে তার মাঝ দিয়ে অর্থাৎ মিলিকে বেধ করে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
মিলি ঘটনার আকস্মিকতায় ক্ষণিকের জন্য হা হয়ে গেলো। কি ঘটেছে তা সে বুঝে উঠতে পারছে না। একটা জলজ্যান্ত মেয়ে তার মতো একটা জলজ্যান্ত মানুষের মধ্য দিয়ে বেধ করে বেরিয়ে গেলো! এটা কিভাবে সম্ভব? সে কি তবে স্বপ্ন দেখছে?
মিলির ভেতর থেকে একটা তাড়া আসলো যে মরিয়মকে কোনোভাবেই হারানো চলবে না। এই মেয়েটির কাছেই রয়েছে সব রহস্যের চাবি। যা হবার হবে। মিলি ঘুরে মরিয়মকে ফলো করতে লাগলো।
মরিয়মের হাতে দূর থেকেই তার বাবার খাবারের বাতিটা দেখা যাচ্ছে। রাস্তা ঘাটের দিকে তাকিয়ে মিলির বিস্ময়ের সীমা রইলো না। তার যদি ভুল না হয়ে থাকে তবে সে এখন শহীদ নুরুদ্দিন সড়ক দিয়ে হাঁটছে। সামনেই পুরনো মসজিদটা দেখা যাচ্ছে। তবে তার অবস্থা পুরোই বেহাল। মসজিদের বাইরে কিছু মসল্লি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। দূর থেকে শুনতে না পারলেও মিলি বুঝতে পারলো কোনও একটা ব্যাপার নিয়ে তারা সবাই খুব উদ্বিগ্ন। মরিয়ম অনেকটুকু এগিয়ে গিয়েছে। তাকে ধরার জন্য দৌড় লাগাতে হল মিলির।
প্রায় মিনিট বিশেক চলার পর মিলিরা এক বিরাট বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালো। বাড়ির উপর বড় করে সাইনবোর্ডে লেখা, “রিচার্ডস জুটমিল”। মিলি এই নামে কোনও জুটমিলের কথা এখানে শুনেনি। ইতিহাসে আগ্রহ থাকায় এখানে আসার পর পরই এ জায়গার অনেক স্থাপনা সম্পর্কে বাবার কাছ থেকে এবং ছোট মামার কাছ থেকে জেনে নিয়েছে সে। তার হিসেব এখন তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে তাদের বাড়ি বেশী দূরে নয়। হেঁটে যেতে মিনিট পাঁচেক লাগবে।
মরিয়ম এক ফাঁকে সেই জুটমিলের দারোয়ানের সাথে কথা বলে ভেতরে ঢুকে গেলো। মিলি খানিকটা ইতস্তত করছে। শেষমেশ মরিয়মের পিছু পিছু সে নিজেও ঢুকে পড়লো।
ঢোকার সাথে সাথে যা দেখল তা দেখার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। না মিলি, না মরিয়ম। একটা সুগঠিত দেহের অধিকারী পুরুষ দেহকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন সাদা চামড়ার মানুষ। শূলে চড়ানো জিনিসটা সম্পর্কে মিলি তেমন কিছু জানে না। তবে তার মনে হলে লোকটাকে যেভাবে ফাঁস দেয়া হয়েছে একেই বুঝি শূলে চড়ানো বলে। লাশটা একটা কড়িকাঠের উপর ঝুলছে। মনে হয় মৃত্যুর আগে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলো, তাই জিহ্বাটা বেরিয়ে গেছে অনেকখানি। দাঁতে আচমকা কামড় লাগায় জিহ্বাটা থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে। নিঃশ্বাসের অভাবে চোখগুলো কোঠর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে প্রায়। হাতদুটো পিছমোড়া করে বাধা। পড়নে শ্রমিকদের পড়ার জামা। মারা হয়েছে বেশী সময় হয় নি। এখনো বাতাসে কিঞ্চিত দুল খাচ্ছে দেহটা।
লোকটার চেহারার সাথে মরিয়মের চেহারার অদ্ভুত মিল লক্ষ্য করলো সে। ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হল যখন মরিয়ম বাবা বলে ছুটে গেলো। লাশটাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিলো। মরিয়মের ছুটে আসার জন্য প্রস্তুত ছিল না মনে হয়। তাকে ধরার জন্য ঝাপিয়ে পড়লো দুজন। একজন মরিয়মকে ধরে উপর হয়ে পড়ে গেলো। মরিয়ম যেখানে পড়েছে তার ঠিক পাশেই কোনও এক শ্রমিক তার পাট কাটার ধারালো ছুরিটা রেখে গেছে মনে হয়। সেটা মরিয়মের হাতে পড়তেই সে উঠে বসে ধাঁই করে ছুরিটা ঢুকিয়ে দিলো সেই ইংরেজের গলা বরাবর!
ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। কিছু রক্ত এসে মরিয়মের ছোট মুখটা ভিজিয়ে দিলো। তার সাদা জামাটা দেখতে দেখতে রক্তে লাল হয়ে উঠলো। মাটিতে পড়ে থাকা ইংরেজটা জবাই করা পশুর মতো লাফাচ্ছে। শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু কণ্ঠনালী কেটে যাওয়ায় সেখান থেকে এক প্রকার ঘড়ঘড় জাতীয় শব্দ তৈরি হচ্ছে। দেখতে দেখতে উঠানটা ভিজে উঠলো তাজা রক্তে।
এর মাঝে দৌড়ে এসে ৩-৪ জন মিলে ধরে ফেলল মরিয়মকে। আরেকজন দ্রুত এসে সেই জবাই হয়ে যাওয়া ইংরেজটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হল না কিছুই। মিনিট দুয়েকের মাঝে মারা গেলো সে।
এরপরের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে লাগলো। কিছু সাদা লোক এসে মাটিতে ফেলে মরিয়মকে বেঁধে ফেলল। আরেকদল ফাঁসির কাঠ থেকে মরিয়মের বাবার লাশ এবং সদ্য মৃত ইংরেজটার লাশ কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলল। বাকিরা মরিয়মকে নিয়ে গাড়িতে উঠালো। মরিয়ম এর মাঝে দস্তাদস্তি করে তাদের অবস্থা খারাপ করে দিচ্ছিল। শুধু তাই নয়, দুইজনের মুখে থুথু ছিটিয়ে দেয় সে।
এই সমস্ত ঘটনা ঘটতে সময় নেয় ১০-১২ মিনিট। এতো দ্রুত সব কিছু ঘটে গেলো যে মিলি কিছু বলতে না পেরে একরকম ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে দেয়। তার সামনের গাড়ি দিয়ে তারা মরিয়মকে নিয়ে যায়। মিলি একপ্রকার ঘোরের মধ্যে সেই গাড়ির পিছন পিছন ছুটে। গাড়িটি রাস্তা থেকে নেমে একটি বাড়ির দিকে মোড় নেয়। মিলি অবাক হয়ে দেখে বাড়িটা তার খুবই পরিচিত। এটা তাদেরই বাড়ি। “এক টুকরো স্বর্গ”!
মিলি পৌঁছানর আগেই তারা গাড়ি থেকে মরিয়মকে নামিয়ে ফেলেছে। ইংলিশে কি কি যেনও কথা হয়। একজন সাহেব গোত্রীয় কেউ চিৎকার দিয়ে কিছু নির্দেশ দিলে বাড়ি থেকে বিশাল মোটা এক লোক বের হয়ে আসে। লোকটার হাতে একটা ধারালো ছুরি। সদ্য ধার দেয়া হয়েছে মনে হয়। আলো পড়ে চিকচিক করছে। পাশে দাঁড়ানো সাহেবদের নির্দেশে সে ছুরিটা তুলে ধরে। মরিয়মকে দু পাশ থেকে চেপে ধরে দুজন। আরেকজন মুখ চিপ দিয়ে জিহ্বাটা বের করে ফেলে।
ছুরি চালায় মোটা লোকটি। মরিয়মের জিহ্বাটা কেটে পড়ে যায়। গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে। জিহ্বাটা কেটে ফেলার সাথে সাথে মরিয়মের হাত ছেড়ে দেয় লোকগুলো। প্রত্যেকেই হাসি মুখে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে মেয়েটির অসহায়ত্ব। মরিয়ম হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে। কাজ হয় না। রক্ত দিয়ে মুখ ভরে তা আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে মাটিতে পড়তে থাকে। সাদা চামড়ার লোকগুলোর যেনও এখনো আশ মেটে নি। বাড়ির ভেতর থেকে একটা গ্যালনে করে কি যেনও এনে মরিয়মের উপরে ঢালতে থাকে। দূর থেকেও নাকে পেট্রোলের গন্ধ পায় মিলি। তার বড় বড় হয়ে যাওয়া চোখের সামনে মরিয়মের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় লোকগুলো। তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে মরিয়ম। নাকে চামড়া পুড়া গন্ধ পেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যায় মিলি।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment