"এই সকাল বেলা কোথায় যাও তুমি?" দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবার সময় পিছন থেকে জিজ্ঞেস করে রুহান। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। তন্বি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে কোন কথা না বলে বের হয়ে যায়। কাল রাতের কথা মনে পরে কেমন যেন লাগতে থাকে রুহানের।
"তন্বির চোখটা কি ফোলা ফোলা ছিলো?" কথাটা মাথায় আসার সাথে সাথে বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে যেয়ে খুঁজতে থাকে তন্বিকে। কারো পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। দৌড়ে ওপরে উঠে দেখে তন্বি উদভ্রান্তের মতো সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে চলে যাচ্ছে। রুহান পিছনে পিছনে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে,
"তোমার কি হয়েছে? বৃষ্টি হচ্ছে না? এই বৃষ্টির মধ্যে ছাদে যাচ্ছো কেন?" তন্বি হাত দিয়ে চোখ মুছে বলে, "এমনি।"
"তন্বি তুমি এখন ছাদে যাবে না। আমি মানা করছি। এখনি নীচে চলো আমার সাথে।" তন্বি এবারও একবার রুহানের দিকে তাকিয়ে কোন কথা না বলে ছাদের দিকে যেতে থাকে। ৮ তলা যাবার পর ছাদের দরজা খুলে ভেতরে চলে যায় তন্বি। আর রুহান কিছু একটা খারাপ ঘটতে যাচ্ছে মনে করে দৌড়াতে দৌড়াতে ছাদে এসে পিছন থেকে তন্বির হাত ধরে ফেলে বলে, "তন্বি আমি কিন্তু ভীষণ রাগ হচ্ছি। তুমি এখনি ছাদ থেকে নামবে। আর আমার সাথে নীচে যাবে।" রুহানের হাত থেকে টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে থাকে তন্বি আর বলতে থাকে, "না আমি তোমার সাথে নীচে যাবো না। আমি কারো সাথে কোথাও যাবো না। আমি মরে যাবো।"
"কেন? মরে যেতে হবে কেন? মরে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া তুমি জানো না? আমি হেরে যাওয়া মানুষ ঘৃণা করি তন্বি তুমি জানো না?" খুব জোরে তন্বিকে ঝাঁকি দিয়ে বলতে থাকে রুহান। তন্বি কিছুক্ষন অপলক তাকিয়ে থেকে বলে,
"কারণ তুমি আমাকে বেঁচে থাকতে দিচ্ছো না।"
"আমি তো তোমাকে বেঁচে থাকতেই বলছি। কাল রাতে আমি তোমাকে সেটাই বলেছি। বেঁচে থাকো, ভালো থাকো। কষ্টহীন একটা জীবন তুমি পাও এটাই আমি চাই।"
"না। তুমি আমাকে বর্ণহীন, রঙহীন একটা জীবন দিচ্ছো। যেই জীবনটাতে আমার কোন সুখ থাকবে না। কোন কষ্ট থাকবে না। কোন স্বপ্ন থাকবে না। এই জীবনটা কি আমার জীবন হবে? এমন জীবন কি আমি চেয়েছি?" বলতে বলতে কাঁদতে থাকে তন্বি।
"আমার কথা বিশ্বাস করো অন্য কারো সাথে তুমি থাকলে সে তোমাকে আমার চেয়ে অনেক বেশী ভালোবাসবে। আমার মত করে কষ্ট দিবে না। আমার মত করে নিজের ইচ্ছা তোমার উপর চাপিয়ে দিবেনা। তোমার কথা শুনবে। তোমার ভালো লাগা খারাপ লাগা গুলো তার কাছে আমার মত গুরুত্বহীন হবে না।"
"না আমার এমন কাউকে লাগবে না। আমি এমন কাউকে ভালোবাসি না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমার জন্য কষ্ট করতে পারি। আমি তোমার জন্য মরতেও পারি। কিন্তু অন্য কারো জন্য কিছু করতে পারবো না। আমার কাছে আর কারো জন্য কিছু অবশিষ্ট নাই।" ছাদের উপর বসে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলতে থাকে তন্বি। বৃষ্টি আর চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে সব কিছু। কথা গুলো যেন আর্তনাদ। শুনলেই টের পাওয়া যায় বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে কষ্টে।
"তুমি এমন করে কাঁদছো কেন? প্লীজ এমন করে কান্না করো না। আমার খারাপ লাগছে।"
"রুহান আমার কান্না দেখতে খারাপ লাগে তোমার তাহলে আমাকে কিভাবে করে তুমি অন্য কারো কাছে চলে যেতে বলছো? তুমি জানো না আমি কেমন? তুমি জানো না আমি খুব বেশী ভালোবাসি তোমাকে?"
"প্লীজ নীচে চলো। এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে তোমার জ্বর আসবে আবার। তুমি এমনিতেই অসুস্থ।"
কথা না বলে কাঁদতে কাঁদতে ছাদের উপর বসে পরে তন্বি। ওর কাছে বসে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রুহান বলে, "খুব বেশী মন খারাপ হয়েছে? আমার কিছুই বলার নাই তোমাকে। আমি এমনি। আমার নিজের মত থাকতে ভালো লাগে। তোমাকে ভালোবাসি না এমন না। যে কারো চেয়ে অনেক বেশী ভালোবাসি। কিন্তু আমি আর সবার মত করে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি না। আমার কারো সাথে বাঁধা থাকতে ইচ্ছা করছে না। তোমার সাথেও না অন্য কারো সাথেও না।" কথাগুলো যখন বলছে রুহান তখন তন্বি দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে ক্রমাগত বলতে থাকে,
"না না না আমি শুনবো না। আমি এইসব আর শুনতে চাই না। প্লীজ প্লীজ তুমি চুপ করো।" পাগলের মত কান্না করতে করতে চিৎকার করে তন্বি বার বার এক কথা বলতে থাকে।
কাউকে বোঝার জন্য ভালোবাসার জন্য সময়টা হয়ত খুব কম। অন্য কেউ শুনলে বলবে এই সময়ে তো একটা মানুষকে চিনতে জানতেই লেগে যায়। তাহলে এর মধ্যে এতো তাড়াতাড়ি ভালোবাসা কেমন করে হয়? তাও আবার এমন ভালোবাসা? সত্যি রুহান নিজেও বুঝে পায় না কিভাবে করে হঠাৎ করে এমন হয়ে গেলো। তন্বি যখন থেকে বড় হয়েছে শুধু দেখেছে মানুষ ওর সুন্দর শরীরের জন্য ওর সাথে মিশতে চেয়েছে। কাছে পেতে চেয়েছে। কেউ কেন যেন ভালোবাসার কথা বলে না। কেউ ভালোবাসে না। মানুষের এমন নোংরা মনের পরিচয় পাবার পর থেকে আর কারো উপর বিশ্বাস করতে পারতো না তন্বি। রুহান তন্বির এই অবস্থা দেখে ওকে আবার মানুষের উপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবে ভেবে তন্বির সাথে কথা বলা শুরু করে। তন্বি তখন এমন এক অবস্থায় ছিলো কাউকে বিশ্বাস করতে পারতো না। কিন্তু রুহানকে কেন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে তাই রুহানের সাথে প্রথম দিন থেকে ভালো ভাবে কথা বলা শুরু করে। একটা মানুষের বুকের মধ্যে যে কত কথা জমা হয়ে থাকে সেটা তন্বির নিজেরও জানা ছিলো না। কথা বলাটাই বলা যায় একটা নতুন সম্পর্কের শুরু। রুহান নিজের জীবনের হতাশার না পাওয়ার কথা বলে তন্বিকে আশার কথা শুনিয়েছিলো। মানুষ মনে করে কথা বলেছিলো। বাঁচতে বলেছিলো। আর তন্বি সেই কথাগুলোকে, রুহানকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে। ভালো একটা বন্ধু হতে চেয়েছিলো রুহান। সব সময় বলতো, "আমি তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হবো তন্বি। এমন বন্ধুত্ব তোমাকে আগে কেউ কখনো দেয় নি।"
রুহান ওর কথা রেখেছে। এমন এক ভালোবাসা তৈরী করে দিয়েছে তন্বির মধ্যে যে এখন আর অন্য কারো ভাবনা মনে আনতে পারে না তন্বি। কি অদ্ভুত অসহায় অবস্থায় যে পড়েছে তন্বি সেটা কাউকে বোঝানোর মত না। এমন কি রুহানকেও বোঝানোর মত না। রুহান যখন মাঝে মাঝে ওকে ছেড়ে চলে যেতে বলে তখন তন্বি কেমন কষ্ট পায় যেটা একমাত্র তন্বি জানে।
প্রায় ডুবে যাওয়া একজন মানুষকে যে পানি থেকে টেনে তোলে তার উপর সারাজীবনের কৃতজ্ঞতা থাকে। কারো কারো কৃতজ্ঞতা হয়ে যায় ভালোবাসা। আর কারো কৃতজ্ঞতা সারাজীবন কাছে থাকার প্রতিজ্ঞা। রুহান আর তন্বির অবস্থা অনেকটা এমন। রুহান বাঁচতে শিখিয়েছে তাই তন্বির রুহানের জন্য হয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা। আর রুহান অন্য কারো কাছে কৃতজ্ঞ যেই কৃতজ্ঞতা রক্ষা করা রুহানের কাছে কারো ভালোবাসা উপেক্ষা করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার চেয়েও অনেক বেশী জরুরী। ভালোই তো চলছিলো সব শুরুর দিকে তাহলে হঠাৎ কি হলো?
শুরুটা ছিলো ঝড়ের মত। হঠাৎ করে দুইজনার পরিচয়। খুব তাড়াতাড়ি কাছে চলে আসা, ভালো লাগা। মনে মনে ভাবলেই তখনি ফোন চলে আসা। সব কিছু ভীষণ ভাবে মুগ্ধ করতো তন্বিকে। রুহান নিজের ভালো লাগাটা গোপন করে রাখতে পারার মত ছেলে না। যখন যা করতে ভালো লাগে সেটাই করে। যখন তন্বিকে অনেক বেশী ভালো লেগেছে তখন তন্বির অনেক বেশী কাছে চলে এসেছে। হাত ধরা অথবা চুমু খাওয়া এই ব্যাপারগুলো ছিলো রুহানের জন্য “তোমাকে ভালো লাগে আমার” এই কথা জানানোর মত শুধুমাত্র। আর তন্বির কাছে অজানা ভুবন। প্রথম ছোঁয়া ! কিছু বুঝে উঠার আগেই কোথেকে প্রবল বেগে আসা আবেগ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব কিছু। কি অদ্ভুত তখনকার অনুভূতি ! কথা না বলেল ভালো লাগে না। দেখা না হলে মনের মধ্যে স্বস্তি নেই। একটু দূরের যাত্রার কথা শুনলেই চোখ ভেঙ্গে কান্না। রুহান অবাক হয়ে একদিন তন্বি কে জিজ্ঞেস করে,
"তুমি কি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো নাকি?"
কেমন অবাক করা একটা প্রশ্ন ! তন্বি কি বলবে ভেবে পায় না। এই কথার কি উত্তর হতে পারে? ভালোবাসা কি সত্যি হয়েছে? অনেক ভাবনা অনেক চিন্তা তারপর অবাক হয়ে নিজেই আবিস্কার করা। হ্যা ভালোবাসা নামের কিছু একটা মনের মধ্যে বাসা বানিয়ে ফেলেছে।
"কি হলো চুপ করে আছো কেন? বলো তুমি কি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো?"
"আমি জানি না। আমি শুধু জানি তুমি আমার পাশে থাকলে আমি ভালো থাকি। তুমি আমার কাছে থাকলে আমার নিজেকে জীবন্ত মনে হয়। তোমার জন্য আমার বাঁচতে ইচ্ছা করে। এটা যদি ভালোবাসা হয় তাহলে আমি তোমাকে ভালোবাসি।"
"ওহ নো! বলো কি? কি বিপদ ! তুমি আমাকে ভালো কেন বাসলে?"
"আমি জানি না কেন। আমি জানি না কিভাবে!"
ভালোবাসার কথাটা এমন করেই বলেছিলো তন্বি। তবে তখন জানা ছিলো না এই নিষ্পাপ ভালোবাসা হয়ে যাবে বেদনায় নীল। তন্বি ভালোবেসে ফেলেছে আর তন্বির সেই পাগলের মত ভালোবাসা উপেক্ষা করা রুহানের কাছে অসম্ভব মনে হয়েছে এক সময়। স্বপ্নময় সময় খুব তাড়াতাড়ি পার হয়ে যায়। যতক্ষন বাহিরে দেখা হয় সেটাকেও মনে হয় যথেষ্ট না। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে রুহান একদিন দুষ্টামী করে বলেছিলো তন্বিকে,
"তন্বি চলো আমরা দুইজন একটা বাসা নি। দুইজন একসাথে থাকবো। আমি একা পারবো না নিতে তোমার আমাকে হেল্প করতে হবে। তাহলে পারবো। কি রাজি?" তন্বি কোন ভাবনা চিন্তা না করেই এক কথায় রাজি।
"হ্যা রাজি। চলো বাসা নেই।"
তারপর রুহান নিজেই একসময় ভুলে গেছে। সেই কথার প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। হঠাৎ একদিন তন্বির ফোন,
"রুহান আমি ধানমন্ডি ৬ এর এ তে আছি। তুমি তাড়াতাড়ি আসো আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে।"
"কোথায় যেতে হবে?"
"সেটা গেলেই দেখবে তুমি তাড়াতাড়ি আসো।" রুহান আসতে আসতে শপিং মলে ঘুরে ঘুরে কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনে সময় পার করলো তন্বি। তারপর রুহান আসলে ওর হাত ধরে বললো,
"চলো রিক্সা নি।"
"আমরা যাচ্ছি কোথায়?"
"এই তো শংকরে"
"কেন?"
"উফ তুমি এতো প্রশ্ন করো কেন? গেলেই দেখবে।"
রিক্সা নিয়ে জাফরাবাদে একটা নতুন কন্সট্রাকশন শেষ হওয়া বাসার সামনে যায় ওরা। তিন তলাতে যেয়ে কলিংবেল দিয়ে রুহানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"কেমন মনে হচ্ছে?"
"কি মনে হবে? কার বাসা এটা?" দরজা খুলে একটা বয়স্ক মহিলা বের হয়ে আসে। আর তন্বি সাথে সাথে সালাম দিয়ে বলে,
"আমার কথা মনে আছে আন্টি? সেদিন বাসা দেখে গিয়েছিলাম। আপনি আমার হাসবেন্ড কে দেখা করতে বলেছিলেন। তাই আজ ওকে সাথে করে নিয়ে এসেছি।" যাকে কথাগুলো বলা হলো তার কি অনুভূতি হয়েছে না হয়েছে রুহান জানে না তবে রুহানের মাথায় যে আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে সেটা নিশ্চিত।
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তন্বির দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবলো এখানে কিছু না বলাই ভালো। পরে জিজ্ঞেস করতে হবে এই পাগলামীর মানে কি!
লিখেছেন-মেঘ_মেঘা
সংগ্রহে - লিমন
"তন্বির চোখটা কি ফোলা ফোলা ছিলো?" কথাটা মাথায় আসার সাথে সাথে বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে যেয়ে খুঁজতে থাকে তন্বিকে। কারো পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। দৌড়ে ওপরে উঠে দেখে তন্বি উদভ্রান্তের মতো সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে চলে যাচ্ছে। রুহান পিছনে পিছনে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে,
"তোমার কি হয়েছে? বৃষ্টি হচ্ছে না? এই বৃষ্টির মধ্যে ছাদে যাচ্ছো কেন?" তন্বি হাত দিয়ে চোখ মুছে বলে, "এমনি।"
"তন্বি তুমি এখন ছাদে যাবে না। আমি মানা করছি। এখনি নীচে চলো আমার সাথে।" তন্বি এবারও একবার রুহানের দিকে তাকিয়ে কোন কথা না বলে ছাদের দিকে যেতে থাকে। ৮ তলা যাবার পর ছাদের দরজা খুলে ভেতরে চলে যায় তন্বি। আর রুহান কিছু একটা খারাপ ঘটতে যাচ্ছে মনে করে দৌড়াতে দৌড়াতে ছাদে এসে পিছন থেকে তন্বির হাত ধরে ফেলে বলে, "তন্বি আমি কিন্তু ভীষণ রাগ হচ্ছি। তুমি এখনি ছাদ থেকে নামবে। আর আমার সাথে নীচে যাবে।" রুহানের হাত থেকে টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে থাকে তন্বি আর বলতে থাকে, "না আমি তোমার সাথে নীচে যাবো না। আমি কারো সাথে কোথাও যাবো না। আমি মরে যাবো।"
"কেন? মরে যেতে হবে কেন? মরে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া তুমি জানো না? আমি হেরে যাওয়া মানুষ ঘৃণা করি তন্বি তুমি জানো না?" খুব জোরে তন্বিকে ঝাঁকি দিয়ে বলতে থাকে রুহান। তন্বি কিছুক্ষন অপলক তাকিয়ে থেকে বলে,
"কারণ তুমি আমাকে বেঁচে থাকতে দিচ্ছো না।"
"আমি তো তোমাকে বেঁচে থাকতেই বলছি। কাল রাতে আমি তোমাকে সেটাই বলেছি। বেঁচে থাকো, ভালো থাকো। কষ্টহীন একটা জীবন তুমি পাও এটাই আমি চাই।"
"না। তুমি আমাকে বর্ণহীন, রঙহীন একটা জীবন দিচ্ছো। যেই জীবনটাতে আমার কোন সুখ থাকবে না। কোন কষ্ট থাকবে না। কোন স্বপ্ন থাকবে না। এই জীবনটা কি আমার জীবন হবে? এমন জীবন কি আমি চেয়েছি?" বলতে বলতে কাঁদতে থাকে তন্বি।
"আমার কথা বিশ্বাস করো অন্য কারো সাথে তুমি থাকলে সে তোমাকে আমার চেয়ে অনেক বেশী ভালোবাসবে। আমার মত করে কষ্ট দিবে না। আমার মত করে নিজের ইচ্ছা তোমার উপর চাপিয়ে দিবেনা। তোমার কথা শুনবে। তোমার ভালো লাগা খারাপ লাগা গুলো তার কাছে আমার মত গুরুত্বহীন হবে না।"
"না আমার এমন কাউকে লাগবে না। আমি এমন কাউকে ভালোবাসি না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমার জন্য কষ্ট করতে পারি। আমি তোমার জন্য মরতেও পারি। কিন্তু অন্য কারো জন্য কিছু করতে পারবো না। আমার কাছে আর কারো জন্য কিছু অবশিষ্ট নাই।" ছাদের উপর বসে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলতে থাকে তন্বি। বৃষ্টি আর চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে সব কিছু। কথা গুলো যেন আর্তনাদ। শুনলেই টের পাওয়া যায় বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে কষ্টে।
"তুমি এমন করে কাঁদছো কেন? প্লীজ এমন করে কান্না করো না। আমার খারাপ লাগছে।"
"রুহান আমার কান্না দেখতে খারাপ লাগে তোমার তাহলে আমাকে কিভাবে করে তুমি অন্য কারো কাছে চলে যেতে বলছো? তুমি জানো না আমি কেমন? তুমি জানো না আমি খুব বেশী ভালোবাসি তোমাকে?"
"প্লীজ নীচে চলো। এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে তোমার জ্বর আসবে আবার। তুমি এমনিতেই অসুস্থ।"
কথা না বলে কাঁদতে কাঁদতে ছাদের উপর বসে পরে তন্বি। ওর কাছে বসে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রুহান বলে, "খুব বেশী মন খারাপ হয়েছে? আমার কিছুই বলার নাই তোমাকে। আমি এমনি। আমার নিজের মত থাকতে ভালো লাগে। তোমাকে ভালোবাসি না এমন না। যে কারো চেয়ে অনেক বেশী ভালোবাসি। কিন্তু আমি আর সবার মত করে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি না। আমার কারো সাথে বাঁধা থাকতে ইচ্ছা করছে না। তোমার সাথেও না অন্য কারো সাথেও না।" কথাগুলো যখন বলছে রুহান তখন তন্বি দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে ক্রমাগত বলতে থাকে,
"না না না আমি শুনবো না। আমি এইসব আর শুনতে চাই না। প্লীজ প্লীজ তুমি চুপ করো।" পাগলের মত কান্না করতে করতে চিৎকার করে তন্বি বার বার এক কথা বলতে থাকে।
কাউকে বোঝার জন্য ভালোবাসার জন্য সময়টা হয়ত খুব কম। অন্য কেউ শুনলে বলবে এই সময়ে তো একটা মানুষকে চিনতে জানতেই লেগে যায়। তাহলে এর মধ্যে এতো তাড়াতাড়ি ভালোবাসা কেমন করে হয়? তাও আবার এমন ভালোবাসা? সত্যি রুহান নিজেও বুঝে পায় না কিভাবে করে হঠাৎ করে এমন হয়ে গেলো। তন্বি যখন থেকে বড় হয়েছে শুধু দেখেছে মানুষ ওর সুন্দর শরীরের জন্য ওর সাথে মিশতে চেয়েছে। কাছে পেতে চেয়েছে। কেউ কেন যেন ভালোবাসার কথা বলে না। কেউ ভালোবাসে না। মানুষের এমন নোংরা মনের পরিচয় পাবার পর থেকে আর কারো উপর বিশ্বাস করতে পারতো না তন্বি। রুহান তন্বির এই অবস্থা দেখে ওকে আবার মানুষের উপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবে ভেবে তন্বির সাথে কথা বলা শুরু করে। তন্বি তখন এমন এক অবস্থায় ছিলো কাউকে বিশ্বাস করতে পারতো না। কিন্তু রুহানকে কেন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে তাই রুহানের সাথে প্রথম দিন থেকে ভালো ভাবে কথা বলা শুরু করে। একটা মানুষের বুকের মধ্যে যে কত কথা জমা হয়ে থাকে সেটা তন্বির নিজেরও জানা ছিলো না। কথা বলাটাই বলা যায় একটা নতুন সম্পর্কের শুরু। রুহান নিজের জীবনের হতাশার না পাওয়ার কথা বলে তন্বিকে আশার কথা শুনিয়েছিলো। মানুষ মনে করে কথা বলেছিলো। বাঁচতে বলেছিলো। আর তন্বি সেই কথাগুলোকে, রুহানকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে। ভালো একটা বন্ধু হতে চেয়েছিলো রুহান। সব সময় বলতো, "আমি তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হবো তন্বি। এমন বন্ধুত্ব তোমাকে আগে কেউ কখনো দেয় নি।"
রুহান ওর কথা রেখেছে। এমন এক ভালোবাসা তৈরী করে দিয়েছে তন্বির মধ্যে যে এখন আর অন্য কারো ভাবনা মনে আনতে পারে না তন্বি। কি অদ্ভুত অসহায় অবস্থায় যে পড়েছে তন্বি সেটা কাউকে বোঝানোর মত না। এমন কি রুহানকেও বোঝানোর মত না। রুহান যখন মাঝে মাঝে ওকে ছেড়ে চলে যেতে বলে তখন তন্বি কেমন কষ্ট পায় যেটা একমাত্র তন্বি জানে।
প্রায় ডুবে যাওয়া একজন মানুষকে যে পানি থেকে টেনে তোলে তার উপর সারাজীবনের কৃতজ্ঞতা থাকে। কারো কারো কৃতজ্ঞতা হয়ে যায় ভালোবাসা। আর কারো কৃতজ্ঞতা সারাজীবন কাছে থাকার প্রতিজ্ঞা। রুহান আর তন্বির অবস্থা অনেকটা এমন। রুহান বাঁচতে শিখিয়েছে তাই তন্বির রুহানের জন্য হয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা। আর রুহান অন্য কারো কাছে কৃতজ্ঞ যেই কৃতজ্ঞতা রক্ষা করা রুহানের কাছে কারো ভালোবাসা উপেক্ষা করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার চেয়েও অনেক বেশী জরুরী। ভালোই তো চলছিলো সব শুরুর দিকে তাহলে হঠাৎ কি হলো?
শুরুটা ছিলো ঝড়ের মত। হঠাৎ করে দুইজনার পরিচয়। খুব তাড়াতাড়ি কাছে চলে আসা, ভালো লাগা। মনে মনে ভাবলেই তখনি ফোন চলে আসা। সব কিছু ভীষণ ভাবে মুগ্ধ করতো তন্বিকে। রুহান নিজের ভালো লাগাটা গোপন করে রাখতে পারার মত ছেলে না। যখন যা করতে ভালো লাগে সেটাই করে। যখন তন্বিকে অনেক বেশী ভালো লেগেছে তখন তন্বির অনেক বেশী কাছে চলে এসেছে। হাত ধরা অথবা চুমু খাওয়া এই ব্যাপারগুলো ছিলো রুহানের জন্য “তোমাকে ভালো লাগে আমার” এই কথা জানানোর মত শুধুমাত্র। আর তন্বির কাছে অজানা ভুবন। প্রথম ছোঁয়া ! কিছু বুঝে উঠার আগেই কোথেকে প্রবল বেগে আসা আবেগ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব কিছু। কি অদ্ভুত তখনকার অনুভূতি ! কথা না বলেল ভালো লাগে না। দেখা না হলে মনের মধ্যে স্বস্তি নেই। একটু দূরের যাত্রার কথা শুনলেই চোখ ভেঙ্গে কান্না। রুহান অবাক হয়ে একদিন তন্বি কে জিজ্ঞেস করে,
"তুমি কি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো নাকি?"
কেমন অবাক করা একটা প্রশ্ন ! তন্বি কি বলবে ভেবে পায় না। এই কথার কি উত্তর হতে পারে? ভালোবাসা কি সত্যি হয়েছে? অনেক ভাবনা অনেক চিন্তা তারপর অবাক হয়ে নিজেই আবিস্কার করা। হ্যা ভালোবাসা নামের কিছু একটা মনের মধ্যে বাসা বানিয়ে ফেলেছে।
"কি হলো চুপ করে আছো কেন? বলো তুমি কি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো?"
"আমি জানি না। আমি শুধু জানি তুমি আমার পাশে থাকলে আমি ভালো থাকি। তুমি আমার কাছে থাকলে আমার নিজেকে জীবন্ত মনে হয়। তোমার জন্য আমার বাঁচতে ইচ্ছা করে। এটা যদি ভালোবাসা হয় তাহলে আমি তোমাকে ভালোবাসি।"
"ওহ নো! বলো কি? কি বিপদ ! তুমি আমাকে ভালো কেন বাসলে?"
"আমি জানি না কেন। আমি জানি না কিভাবে!"
ভালোবাসার কথাটা এমন করেই বলেছিলো তন্বি। তবে তখন জানা ছিলো না এই নিষ্পাপ ভালোবাসা হয়ে যাবে বেদনায় নীল। তন্বি ভালোবেসে ফেলেছে আর তন্বির সেই পাগলের মত ভালোবাসা উপেক্ষা করা রুহানের কাছে অসম্ভব মনে হয়েছে এক সময়। স্বপ্নময় সময় খুব তাড়াতাড়ি পার হয়ে যায়। যতক্ষন বাহিরে দেখা হয় সেটাকেও মনে হয় যথেষ্ট না। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে রুহান একদিন দুষ্টামী করে বলেছিলো তন্বিকে,
"তন্বি চলো আমরা দুইজন একটা বাসা নি। দুইজন একসাথে থাকবো। আমি একা পারবো না নিতে তোমার আমাকে হেল্প করতে হবে। তাহলে পারবো। কি রাজি?" তন্বি কোন ভাবনা চিন্তা না করেই এক কথায় রাজি।
"হ্যা রাজি। চলো বাসা নেই।"
তারপর রুহান নিজেই একসময় ভুলে গেছে। সেই কথার প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। হঠাৎ একদিন তন্বির ফোন,
"রুহান আমি ধানমন্ডি ৬ এর এ তে আছি। তুমি তাড়াতাড়ি আসো আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে।"
"কোথায় যেতে হবে?"
"সেটা গেলেই দেখবে তুমি তাড়াতাড়ি আসো।" রুহান আসতে আসতে শপিং মলে ঘুরে ঘুরে কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনে সময় পার করলো তন্বি। তারপর রুহান আসলে ওর হাত ধরে বললো,
"চলো রিক্সা নি।"
"আমরা যাচ্ছি কোথায়?"
"এই তো শংকরে"
"কেন?"
"উফ তুমি এতো প্রশ্ন করো কেন? গেলেই দেখবে।"
রিক্সা নিয়ে জাফরাবাদে একটা নতুন কন্সট্রাকশন শেষ হওয়া বাসার সামনে যায় ওরা। তিন তলাতে যেয়ে কলিংবেল দিয়ে রুহানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"কেমন মনে হচ্ছে?"
"কি মনে হবে? কার বাসা এটা?" দরজা খুলে একটা বয়স্ক মহিলা বের হয়ে আসে। আর তন্বি সাথে সাথে সালাম দিয়ে বলে,
"আমার কথা মনে আছে আন্টি? সেদিন বাসা দেখে গিয়েছিলাম। আপনি আমার হাসবেন্ড কে দেখা করতে বলেছিলেন। তাই আজ ওকে সাথে করে নিয়ে এসেছি।" যাকে কথাগুলো বলা হলো তার কি অনুভূতি হয়েছে না হয়েছে রুহান জানে না তবে রুহানের মাথায় যে আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে সেটা নিশ্চিত।
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তন্বির দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবলো এখানে কিছু না বলাই ভালো। পরে জিজ্ঞেস করতে হবে এই পাগলামীর মানে কি!
লিখেছেন-মেঘ_মেঘা
সংগ্রহে - লিমন
No comments:
Post a Comment